আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিভাবে তাকে সান্ত্বনা দেব, কি বলেই বা সান্ত্বনা দেব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কয়েক মুহুর্ত ভেবে চিন্তে, আস্তে করে তার পিঠের উপর হাত জড়ালাম কয়েকবার। তারপর মাথায় হাত রেখে বললাম, এমন সামান্য একটা ব্যাপারে কেউ কি বোকার মত এত হাউমাউ করে কাঁদতে পারে?
আচ্ছা হাসি, তুই এত সহজ-সরল কেন? তোর মত এত সহজ-সরল হাসি আর এত সহজ-সরল কান্না আমি পৃথিবীর কোথাও দেখতে পাই না। প্লিজ হাসি কান্না থামা। তুই এত ছোট হয়ে গেলি কিভাবে?
অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে সে শান্ত হলো। কিন্তু লাজুক ভাব নিয়ে আমাকে জড়িয়ে রইল এখনো। বললাম হাসি, আমার দিকে দেখ্। আমার চোখেচোখে তাকা। একটু পর মাথা উঠালো সে। কেঁদে কেঁদে ওর দুটি চোখ ক্লান্ত হয়ে গেল যেন। দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওর দু’চোখের জমে থাকা অশ্রু মুছে দিলাম। তার কাজল কালো দুটি চোখ অশ্রুতে ধুয়ে আরো বেশি শান্ত ও স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। কান্নার আগে আমি তার চোখে এক রকম সৌন্দর্য দেখেছি, কান্নার পর দেখছি অন্য রকম সৌন্দর্যের আবহ। এখন ওর চোখেমুখে আরো বেশি মায়া জড়িয়ে রইল।
তার চোখেমুখে চেয়ে বললাম, আমার উপর তোর বিশ্বাস আছে?
তার কোমল কণ্ঠে সামান্য শব্দ করে একটু বিলম্বে বলল, আছে।
আমার উপর তোর বিশ্বাস যদি থেকেই থাকে, তাহলে এই বিষয়টা তুই আমার উপর ছেড়ে দে। এ ব্যাপারে তোকে আর একটুও ভাবতে হবে না। চিন্তা করতে হবে না। উদ্বিগ্ন হতে হবে না।
এবার সে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে থাকল। কিছুই বলল না। বিষয়টা কত মর্মান্তিক, কত বেদনাদায়ক, কতই না নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক; কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। মানুষ কত বেশি নিষ্ঠুর হলে, মূর্খ হলে, কতটুকু বিবেকহীন হলে; এমন একটা বিয়ের আয়োজন করতে পারে, আমার জানা নেই।
এমন একটা অবুঝ মেয়েকে হাতপা বেঁধে, বাজারের পণ্যের মত দর কষাকষি করে, আপদের মত বিদায়ের আয়োজন চলছে।
আমি হাসিকে কোনোদিন এত অসহায় দেখিনি। তাকে বড়ই অবহেলিত মনে হলো। আমার বিবেক সাড়া দিল, আমি যেন তার পাশে দাঁড়াই। এমন অসহায়ত্বের কারণে সে আমার মনেপ্রাণে মিশে গেল। এ অবস্থায় আমি যদি তাকে জড়িয়ে না রেখে ঘুরে দাঁড়াই, তাহলে বড় অন্যায় করা হবে। আমি তা কখনোই পারব না। কোনদিনই পারব না। এমন সাদাসিধে মেয়েটি আমাকে তার মনের সবকথা বলে। মনের আনন্দ আর হিমেল কষ্টের নোনা ব্যথা সবই নির্ধিদায় বলে যায় সে। আমি তাকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারি? একদম না।
কোনো কথা না বলে, আমি তাকে হাত ধরে ইশারা করলাম, ঘরে ফিরতে। সে উঠে দাঁড়াল। দু’জনেই পুকুর পাড় থেকে চলে আসলাম। সন্ধ্যা নামছে চারপাশ ঘিরে। এতক্ষণে হয়ত হাসিকে ওর মা-বাবা খুঁজতে শুরু করেছে। তার আর আমার এমন নির্জন কথা প্রকৃতিও যেন নীরব হয়ে শুনেছিল।
পরদিন সন্ধ্যায় হাসিদের ঘরে গেলাম। ওরা চার ভাইবোন। হাসি সবার বড়। তার ছোট দুই ভাই আনিস ও রহিম এবং সবার ছোট এক বোন শেফালী। হাসি পড়ার টেবিলে। মনোযোগ সহকারে পড়ছে। হাসির হাসিটা খুব মিষ্টি। তাই হয়ত চাচা-চাচি তাকে হাসি বলেই ডাকে।
হাসির কোনো দিকেই দৃষ্টি নেই। দৃষ্টি শুধু বইয়ের পাতায়। আমি তার পাশেই একটা চেয়ারে বসলাম। তবু আমার প্রতি তার একটুও দৃষ্টি পড়ল না। সে বুঝতে পারল না, আমি কখন এলাম। সে শুধু পড়েই যাচ্ছে, একজন সুন্দরী সংবাদ পাঠিকার মত। তার মিষ্টি মুখে কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে যেন। একটার পর আরেকটা পড়া। একটা প্রশ্নোত্তরের পর আরেকটা প্রশ্নোত্তর শিখছে সে। আমি হাসির মনোযোগ সহকারে অধ্যয়নে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা যেসময় রাতে একটু পড়েই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম, সকালে স্কুলের পড়া কোনো রকম শিখে স্যারের বেত্রাঘাত থেকে বাঁচতাম; এ সময় সে পড়তে হবে জেনেই পড়ছে। অথচ সে ভালো করেই জানে, তার বিয়ের আর বেশিদিন বাকী নেই। এখন ফাল্গুন মাসের ১৪ তারিখ। এ মাসের ২৫ তারিখ হাসির বিয়ে। এ ব্যাপারে ওর যেন কোনো ভাবনা নেই। কোনো দুশ্চিন্তা নেই। অনেকক্ষণ পর আমার উপর চোখ পড়ল হাসির। এবার সে পড়া বন্ধ করে, আমার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকাল। বড্ড খুশি হয়ে বলল, ভাইয়া আপনি!
আমি মৌন হাসি জড়িয়ে বললাম, হ্যাঁ আমি।
আপনি এসেছেন ভালো করেছেন। আপনার সাথে গল্প করা যাবে।
এখন তো গল্প করা ঠিক হবে না। এখন যে পড়ার সময় হাসি। তুমি পড় আমি দেখি। তারপর চলে যাব।
না আপনি যেতে পারবেন না। আমার সাথে গল্প না করে আপনাকে যেতে দেব না।
আমি যাচ্ছি না। তুমি পড়। এবার হলো তো?
সে আবার পড়ায় মন দিল।
হাসিদের ঘরটি পূর্বমুখী। তিন কক্ষ বিশিষ্ট। একেবারে উত্তর কক্ষে হাসি আর আমি, অন্য কেউ নেই। মাঝখানের কক্ষে একটি চৌকি বসানো হয়েছে। দক্ষিণ পাশের কামরায় আনিস ও রহিম আওয়াজ করে পড়ছে। আন্টি রান্না ঘরে। সাথে শেফালী আছে। গফুর চাচা বাড়ি নেই। বাজারে গল্পে মেতেছেন হয়ত। চা আর পান খেয়ে গল্প করতে খুব পটু তিনি। বাপদাদার কথা, নিজের কথা, সংসারের সুখ-দুঃখের কথা মিলিয়ে বেশ জমিয়ে তুলেন আড্ডা। সে আড্ডা শেষ হতে অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত হয়ে যায়।
হাসির কক্ষের পশ্চিম পাশে একটি খাট বসানো। উত্তর-পূর্ব কোণায় বই খাতা সাজানো ওর পড়ার টেবিলটি। আমি দক্ষিণ পাশে। সে টেবিলের পশ্চিম পাশে বসে পূর্ব মুখী হয়ে পড়ছে। তার একটু দক্ষিণেই দরজা আর তার পাশেই পূর্ব-পশ্চিমে বাঁশের ফুল করা বেড়া। বেড়ার মাঝের দরজাটি একটি বড় ফুলের পর্দার মাধ্যমে আড়াল করা হয়েছে।
হাসি পড়ছে। আমি তার পড়ার অনুপম ভঙ্গি অবলোকন করছি। যেন হুবহু বুঝতে পারছি না তারে। মাঝে মাঝে সে আমার দিকে তাকায়। আমি তখনো চেয়ে থাকি তার পানে। কিছুই বলি না। এক সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি হাসিকে হারিয়ে ফেললাম। আসলে জীবন এমনই। হঠাৎ করে তার বিপরীত অর্থ হয়ে দাঁড়ায়। আলোর জায়গায় দখল নেয় গভীর অন্ধকার। খুব কাছের আপনজনও কখনো কখনো দূরে হারিয়ে যায়। দিয়ে যায় এক পৃথিবী শূন্যতা।
চলবে…
উপন্যাসিক: মোঃ নূরুল আলম আবির
প্রকাশ: ২১শে বইমেলা ২০০৯ (৩য় পর্ব)