ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনজুর হোসেন বুলবুল কর্তৃক বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একটি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের সড়কটি নির্মাণের এক মাসের মধ্যেই একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়া ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণের ১০দিনের মধ্যেই রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ ধ্বসে গিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আরেকটি রাস্তা নির্মাণের সময় কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি করা হয়েছে সংসদ সদস্যর কাছের লোকজনদের।একারনে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ মনজুর হোসেন বুলবুল বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ প্রদান করেন।
অবকাঠামা সংস্কার (কাবিখা/কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের ৩য় কিস্তির বরাদ্দের পরিমাণ দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলম। আরেকটি প্রকল্প চরবাকাইল খাঁন জাহান মুন্সীর বাড়ি থেকে মাহামুদ খানের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তায় মাটির কাজ ও ইটের সলিং নির্মাণ কাজের বরাদ্দ দেওয়া হয় দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নজির আহম্মদের বাড়ী থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হাসানের বাড়ী পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দশ লাখ টাকা।
এছাড়া পানাইল ছরোয়ার জুমাদ্দার এর বাড়ী থেকে সোনাউল্লাহর বাড়ীর পাশে পাকা রাস্তা পর্যন্ত ইটের সলিংকরণ ও প্যালাসাইডিং নির্মাণ কাজ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) সুলতান মাহামুদ। এছাড়া চরকাতলাসুর ৭ নং ওয়ার্ড কালভার্ট হয়ে শাহাদত খান এর বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ টাকা।এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ী থেকে মুরাদ জমাদ্দার এর বাড়ী পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়াও চরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ভরাট প্রকল্পে ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ সহ বিভিন প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সরজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে বিলের মধ্যে নিচু জায়গায়। ইতিমধ্যেই পানি বাড়ায় একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া রাস্তাটি কনোরকম মাটি ফেলা হয়েছে। সমানও করা হয়নি রাস্তাটি।
স্থানীয় বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান বলেন, বিলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তাটি নিচু হওয়ায় বর্ষামৌসুমে সম্পুর্ন তলিয়ে যাবে। পানি বাড়ায় ইতিমধ্যেই রাস্তাটির মাঝের একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। জনসাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাস্তাটি নির্মাণ করা হলেও এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাস্তাটি পারাপার হতে পানির মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে হয়। রাস্তাটি নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। এবিষয়ে এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ফোন রিসিভ করেন তার মেয়ে। তিনি বলেন, আব্বু বাসায় নেই। কখন আসবেন তিনি জানেন না বলে ফোনটির লাইন কেটে দেন।
সরজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নেরর পানাইল নজির আহম্মদর বাড়ী থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হাসানের বাড়ী পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটির মাঝখানে একটি অংশ কেটে রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, ওই খানে একটি কালভার্ট বসানো হবে এজন্য কেটে রাখা হয়েছে। ওই সড়ক দিয়েও চলাচল করতে মাজা সমান পানি পার হয়ে পারাপার হতে হয় জনসাধারণকে। এদিকে এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় যে মাটি লেগেছিল, মাটি নেওয়া হয়েছিল রাস্তার পাশের জমি থেকে। ওই সময় জমির মালিকদের বলা হয়েছিল ক্ষতিপূরন দেওয়া হবে, কিন্ত নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় বাসিন্দা রমজান শেখ বলেন, রাস্তা নির্মাণের সময় আমাদের বলা হয়েছিল তোমাদের জমি থেকে মাটি দেও তোমাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু পরে নামমাত্র ১ হাজার, ২হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাদের জমি থেকে মাটি নেওয়া হয়েছে সেই জায়গায় এখন হাটুপানি হয়ে গেছে। কোনা ফসল উৎপাদন করতে পারবো না আমরা।আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই রাস্তাটি কাজের সময় সংসদ সদস্যর চাচাতো ভাই দেখাশােনা করেছেন একারনে ভয় কেউ কিছু বলেননি।
এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ী থেকে মুরাদ জমাদ্দার এর বাড়ী পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন অংশ ধ্বসে গেছে। রাস্তা নির্মাণের মাত্র দশ দিনের মধ্যেই ধ্বসে গেছে একাধিক জায়গা।খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ মনজুর হোসেন বুলবুর কর্তৃক বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলাের বেশিভাগ প্রকল্পের পিআইসি রয়েছেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফ জয় বকুল। স্থানীয়দের অভিযোগ সংসদ সদস্যর আস্থাভাজন হওয়ায় বেশিরভাগ নির্মাণ কাজই করে থাকেন তিনি।
বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল বলেন, পানাইল এলাকায় যা ইটের সলিং এর রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ওই এলাকা নিচু হওয়ায় আশ পাশের বাড়ি থেকে বৃষ্টির ঢলের পানি এসে রাস্তার উপর বেকু মেশিন দিয়ে কেটে ফেলানো নতুন বালি ধ্বসে যায়। অন্যান্য প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। তবে কিছু প্রকল্প নিচু এলাকায় হওয়ায় সমস্যা হয়েছে।
পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকার বিষয়ে টগরবন্দ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিক ফকির বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে সংসদ সদস্যর কোনো যোগাযোগ নেই। সংসদ সদস্য তার নিজস্ব কিছু লোকজন-বাহিনি দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজগুলো করিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, একারনে উনয়নমূলক কোনো কাজের ব্যাপারে আমরা খোঁজ খবর রাখিনা। অনিয়ম হলেও আমরা দেখতে যাইনা। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ নেই।
এ প্রসঙ্গে আলফাডাঙ্গা উপজলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হােসন বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে এমপির কনো যোগাযোগ নেই। তিনি স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত এর লােকজনদের নিয়ে চলাফেরা,কাজ-কাম করে থাকেন। আওয়ামী লীগের কনো নেতাকর্মীদের সাথে তাঁর কােন কথাবার্তাও হয়না। তিনি আরও বলন, এলাকায় তার কিছু নিজস্ব লাকজন ও বাহিনী রয়েছে তাদের নামেই প্রকল্পগুলাের বরাদ্দ দেওয়া হয়। এমনকি একেকজনের নামে একাধিক প্রকল্পও দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে লোকমুখে শুনেছি। যেহেতু তিনি আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখেননা, সেকারনে ওই কাজগুলাের ব্যাপারে আমরা কনো খোঁজ খবর রাখিনা।
প্রকল্পের নির্মাণকাজের বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান বলেন, এমপি মহোদয় একজন সজ্জন ব্যক্তি। এলাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ করেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে। আমি বর্তমানে ঢাকায় আছি, এলাকায় গিয়ে সকল প্রকল্প পরিদর্শন করবো।
উপজলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) প্রনব পান্ডে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ লাকমুখে শুনেছি। প্রকল্পগুলোর বিল এখনও দেওয়া হয়নি। সরজমিন গিয়ে কাজর অগ্রগতি পরিদর্শন করে বিল প্রদান করা হবে।
আলফাডাঙ্গা উপজলা নির্বাহী কর্মকর্তা তহিদ এলাহী বলেন, এই প্রকল্পগুলার বরাদ্দ একটু দেরিতে আসায় বর্ষা মৌসুমেই কাজ করেতে হচ্ছে। একারনে কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি।
এ বিষয় কথা বলতে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ মনজুর হোসেন বুলবুলল এর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।তবে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ মনজুর হোসেন বুলবুল এর এপিএস মমিন ইমন এর সাথে মোবাইলে কথা হলে তিনি জানান, কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কিছু প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় বর্ষার পানির কারনে সমস্যা হয়েছে, সেগুলা দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।