শিশুশ্রম দেশব্যাপী একটা বড় সমস্যা।শিশুরা শ্রমের হাতিয়ার নয়,জাতির ভবিষ্যৎ।শিশুদের হাতে বই ও কলমই শোভা পায়।তারা বিভিন্ন কাজে শ্রম বিক্রি করেও প্রকৃত মজুরি থেকেও বঞ্চিত হয়।শিশুদের কেউ কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে আসছে।শিশু শুধু মা-বাবা নয়,জাতির আশা,আকাক্সক্ষা,প্রত্যাশা ও স্বপ্নের অপর নাম।
জাতীয় শিশু সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী মানুষের পরিচয় হলো শিশু।অথচ এইসব শিশুদের কাঁধেই শ্রমের বোঝা।কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে শিশু শ্রমের নানা ধরনের দৃশ্য।আর্থসামাজিক টানাপড়েন আর জীবনের বাস্তবতায় কোনো কোনো শিশুকে শৈশব আর কৈশোরের সব চাওয়া-পাওয়া ও আনন্দকে বিসর্জন দিতে হয়, পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়,কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হতে হয় বলে মনে করছেন অনেকেই।
এব্যপারে সুশীল সমাজ মনে করছেন,যে বয়সে কোনো শিশুর বই,খাতা ও পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া এবং আনন্দিত চিত্তে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা,সেই বয়সেই শিশুকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে।অর্থনৈতিক দুরবস্থায় অনেক মা-বাবা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেন না।স্বল্পশিক্ষিত মা-বাবা দারিদ্র্যের কশাঘাতে যখন পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হন,তখন তারা সন্তানকে স্কুলে পাঠানো এবং লেখাপড়ার খরচ জোগাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।তারা মনে করেন,তাদের সন্তান কাজে নিয়োজিত থাকলে সংসারের আয় সংকুলানে সহায়ক হবে।
আরমানের বয়স ১৫।১৩ বছর বয়স থেকেই সে কাজ করছে একটি গ্রীল ওয়ার্কসপে।ভোর থেকে লোহালক্কড় দিয়ে কাজ শুরু হয়,সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।বিনিময়ে মাসে মাত্র যে টাকা পায় তা শ্রমের তুলনায় নেহাতই সামান্য।সোহেলের সাথে কথা বলে জানা যায়,সে একসময় স্কুলে যেত,সংসারের টানাপোড়েনের কারণে পেটের দায়ে এখানে কাজ নেয় সে।অমানুষিক পরিশ্রমে সে হাঁপিয়ে ওঠেছে,সপ্তাহে কোনো ছুটিও নেই।
সাদিয়ার বয়স ১৪ হবে।চার ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়।তার বাবা রিকশা চালায়।সাদিয়া ভোর হতেই ছুটে যায় মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে।কাপড় ধোয়া,ঘর মোছা,থালাবাসন মাজা,গৃহস্থালি অন্য কাজসহ খাটে নানা ফুট-ফরমাশ।সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে।এর মধ্যে চুন থেকে পান খসলেই বকাঝকা তো রয়েছেই।এতো কাজ করে বেতন পায় সামান্যই।শুধু আরমান কিংবা সাদিয়ার গল্প নয়,তাদের মতো বহু শিশুশ্রমিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কাজে।
দেশে এ বিষয়ে কঠোর আইন আছে,তবে অশিক্ষা তথা পরিবারের অসচেতনতা ও অসচ্ছলতা আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের শিশু শ্রমের আইন অমান্য করার কারণে এ অবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে না বলে মনে করছেন সচেতন মহল।তারা জানান, শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনীতি আর চলমান করোনা পরিস্থিতি।তাছাড়া নদীভাঙন,বন্যা,খরা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক শিশু বই খাতা ছেড়ে নেমে আসে অর্থ উপার্জনের পথে।বাস্তবতায় কিছু মুনাফালোভী মানুষ স্বল্প মজুরির বিনিময়ে শিশুদের কাজে লাগায়,আবার সুযোগ পেয়ে অধিক সময় কাজে নিয়োজিত রাখে।
অথচ শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নির্ধারণ করে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম বন্ধের অঙ্গীকার করেছে।শুধু তা-ই নয়,শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রেও শর্ত আরোপ করা হয়েছে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা, ২০১০-এ,এতে বলা হয়েছে ১৮ বছরের নিচে শিশুকে কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।বাংলাদেশ সংবিধানে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে এবং জবরদস্তিমূলক শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমসহ সব ধরনের শ্রমসাধ্য কাজ থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করে তাদের জীবনকে অর্থবহ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।