নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের পেমই গ্রামের কৃতিসন্তান সাবেক প্রধান বিচারপতি ও মহামান্য সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আজ শনিবার সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুর সংবাদ নিজ জেলা নেত্রকোনায় ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের লোকজনের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
শনিবার বেলা ২টা ৩০ মিনিটের দিকে তার মরদেহ ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে কেন্দুয়া আদমপুর হেলিপ্যাড মাঠে নিয়ে আসা হয়। সেখানে মরহুম রাষ্ট্রপতির মরদেহ দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে। হেলিকপ্টার থেকে রাষ্ট্রপতির মরদেহ গ্রহন করেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসনের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক জিয়া আহমেদ সুমন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী, কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মইনউদ্দিন খন্দকার, কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র আসাদুল হক ভূঞাসহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
পরে মরহুমের মরদেহ একটি লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ী পেমই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। জানাজার পূর্বে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের ছেলে সোহেল আহমেদ অলিক উপস্থিত এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলেন, আমার বাবা গ্রামকে খুব ভালোবাসতেন।
সব সময়ই গ্রামে আসতে চাইতেন। কিন্তু আমরা বিদেশে থাকায় বাবার গ্রামে আসা সম্ভব হয়নি। ভেবেছিলাম বাবাকে আপনাদের কাছে জীবিত নিয়ে আসব। কিন্তু তা আর হলো না। তিনি উপস্থিত সবার কাছে তার পিতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে নিজ বাড়ির আঙ্গিণাতেই মরহুম রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মরহুমের লাশ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
দ্বিতীয় জানাযা রবিবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। পরে বনানীতে স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হবে। এদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছেন। উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।
তার বাবা তালুকদার রিসাত আহমেদ ছিলেন একজন সমাজসেবী ও এলাকায় জনহিতৈষী ব্যক্তি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বি এ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহন করেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কর্মজীবনের সূচনা ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে। সহকারী জেলা প্রশাসক হওয়ার পর ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন। পরবর্তী সময়ে কর্মদক্ষতা, সততা, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসীন হন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ প্রধান বিচারপতি হিসেবে। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯১ সালে তার অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
পরে শর্তানুযায়ী তাকে পূনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২৩শে জুলাই তাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করা হয়। ২০০১ সালের ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। এরপর গুলশানের বাসভবনে অনেকটা নিভৃত জীবন যাপন করছিলেন। সাহাবুদ্দীন আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা আহমদ দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভূগে ২০১৮ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান। তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৩শে জুন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মারা যান। বর্তমানে তার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে।