আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে, মানুষের আবাসণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে হাউজিং কোম্পানীগুলো বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলছে হাওড় বাওড় খাল বিলসহ সকল জলাশয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে জলাশয় ভরাট করা হলে এক সময় তীব্র পানি সঙ্কটে পড়বে দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পড়বে গোটা দেশ। ধাপে ধাপে মরুভুমিতে পরিণত হবে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলা। তখন হা-পিত্যেশ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এ প্রবাদ কমবেশি সকলেরই জানা। নদীমাতৃক এদেশে ছড়া, খাল, বিল, নদী, সমূদ্র, দিঘি, পুকুর, ডোবা সবখানে এক সময় মাছ পাওয়া যেত। গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ বাঙালির ঐতিহ্য। বাঙালিরা ঝাঁকি জাল, চাই, ডুক, পলই ইত্যাদি দেশিয় মাছ ধরার উপকরণ ব্যবহার করতো। অধিকাংশ লোক বাজার থেকে মাছ না কিনে খাল-বিল, দিঘি, পুকুর ডোবা ইত্যাদিতে ঝাঁকিজাল ব্যবহার করে মাছ ধরে টাটকা মাছ খেতে পারতো।
বড়শির টোপে জড়িয়ে আছে অনেকের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া। বড়শিতে চলে ওদের সংসার। বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নদী-খাল ভরাট হয়ে মিঠা পানির মাছ কমে যাওয়া আর গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীতে কেবল কাজের ধরন পাল্টে গেলেও বড়শিতেই বাঁধা রূপগঞ্জের শতাধিক পরিবারের কয়েক শ জীবন।
নগরায়ন, বাড়িঘর, দোকানপাট সৃষ্টির আধিক্যের কারণে দেশের বহু পুকুর, দিঘি, ডোবা, ঝিল, হাওর ইত্যাদি ভরাট হয়ে গেছে দেশে পুকুর, ডোবা ভরাটের কারণে মাছ ধরার কাজে ব্যাপক হারে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা ও বর্তমানে অনেক খানি কমে গেছে।
জলাশয়ে ছিপ ফেলে বড়শি দিয়ে আঁধার গেঁথে মাছ ধরাটা গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যাবার পথে। হঠাৎ কোন হ্যাচকা টানের শব্দ কিংবা নিরব শিকারী বড়শী হাতে পুকুর-খাল ও বাড়ীর পাশের পতিত জলাশয়ের পাশে চুপচাপ বসে আছে ছিপ কেঁপে ওঠার আশায়, গ্রাম বাংলার মেঠোপথের ধারে এমন চিত্র আগে মিলতো হর-হামেশাই। ডুবা কেঁপে উঠলেই আচমকা বড়শীতে টান দেয়, তখন হয়তো উঠে আসে বাহারী কোন রুপালী রঙের মাছ।
উপজেলার নগরপাড়া এলাকার আবুল হোসেন কাজী (৭৮) জানান, ১৫-২০ বছর ধরে বড়শিতে মাছ শিকার করছেন তিনি।ভালই তো লাগে। খাবারের পাশাপাশি অতিরিক্ত মাছ বাজারে বিক্রি করে বাড়তি কিছু আয় হয়। সংসারের কাজে লাগে।বড়শী দিয়ে মাছ শিকারী শিপলু জানান, ছোটবেলা থেকেই শখের বশে নিজে বড়শী দিয়ে মাছ শিকারের পাশাপাশি এর সরঞ্জামও তিনি বিক্রি করেন।নানা ধরনের ছোট বড় মাছের জন্য বিভিন্ন রকমের বড়শী, ছিপ, চুবা, সুতা, হুইলার ইত্যাদি তিনি বিক্রি করেন।
ধরন অনুযায়ী একেকটার একেক রকমের দাম।গ্রামের দরিদ্র পরিবারের কেউ কেউ বড়শী দিয়ে ছোট ছোট মাছ যেমন- টাকি, পুঁটি, শোল, ঘুইঙ্গা, বাইন, কৈ ইত্যাদি ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায় আবার কেউ বড় বড় পুরনো পুকুর -দীঘিতে সৌখিন ভাবে দলবদ্ধ হয়ে টিকেট কেটে বড় মাছ ধরে।কেউ মাছ ধরে পেটের তাগিদে আর কেউ মাছ ধরে সৌখিনতার জন্য তবে সবগুলোরই মাধ্যম কিন্তু বড়শী।
রহিম মিয়ার কলেজ পড়–য়া ছেলে মিজানুরের লেখাপড়ার খরচ চলে বড়শিতে মাছ শিকারের টাকায়। লেখা পড়া না জানলেও কোনো রকমে মোবাইলফোন রিসিভ করতে শিখেছেন তিনি।নদীতে বিপদ-আপদে মোবাইল ফোনে খোঁজখবর নেন পবিবারে সদস্যরা। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আবার কোনো দিন ১০০০ থেকে ১৫শ’বা ২ হাজার টাকা আয় করেন তিনি বড়শিতে মাছ শিকারে।
ডিঙি নৌকায় চড়ে বড়শিতে মাছ শিকার করেন একই এলাকার বাদশা মিয়া (৫০), রাজু (৩৫), মাসুদ সহ অর্ধশতাধিক মাছ শিকারি। বড়শিতে মাছ শিকারে চলে এদের প্রত্যেকের সংসার।বাদশা মিয়া বলেন, ‘দিনে দিনে সবকিছু পাল্টাই যাচ্ছে। খাল বিল, নদীনালা পুকুর ভরাট অইতে আছে। আগের মতো অনেক মাছও আর নাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘জায়গা-জমি নাই। দিন-রাইত পানিতে ভাইস্যা মাছ শিকার করোন অনেক কষ্টের কাম।
ঘর-সংসার আর ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার পানে চাইয়া বড়শি বাই।’বড়ালু এলাকার সেলিম খান জানন, অনেক কাঁকড়া শিকারিও এ সময় বড়শিতে মাছ শিকার করতে আসতেন।আবহাওয়ার পরিবর্তন, রেনুপোনা নিধন, মা মাছ শিকার, নদী ভরাট, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীতে মাছ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠেছে। শিকারির বড়শিতেও আর আগের মতো মিলছে না মাছ। অনেক জেলে পরিবারের ছেলেমেয়ে নিয়ে কাটাছে দুর্বিষহ জীবন।’
রূপগঞ্জ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির কারণে পেশা ছাড়ছেন বড়শিতে মাছ শিকারিসহ অনেক জেলে।
আমাদের মাছে ভাতে বাঙালির ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখার স্বার্থে দেশের জলাশায়, পুকুর, দীঘি, খাল ইত্যাদি ভরাট বন্ধ করা জরুরি। সাধারণ মানুষের মাছ ধরার ঐতিহ্যগত রীতি দেশে অব্যাহত রাখতে নগরায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাছের বসবাসের পরিবেশের প্রতি যতœশীল হওয়া সরকারসহ সকল নাগরিকের কর্তব্য।