আমাদের দেশে গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে এক সময় আলোর অন্যতম বাহন ছিলো সন্ধ্যাবাতি হারিকেন। যুগের পরিবর্তন আর বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির কারণে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই হারিকেনের স্থান দখল করে নিয়েছে বিদ্যুৎ ও সোলার লাইট। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হারিকেন এখন শুধুই স্মৃতি।
কালের স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী হারিকেন। গ্রাম বাংলার ছাত্র-ছাত্রীসহ সকল পরিবারের মাঝেই ছিল হারিকেন, সেই আলোকিত বাতি এখন বিলুপ্তির পথে। সন্ধ্যার নামতেই অন্ধকার দূর হতো একটা সময় হারিকেন, দোয়াত ও কুপি বাতি দিয়ে। রাতে হারিকেনের বাতি মিট মিট করে জলার দৃশ্য সবার নজর কাড়তো। বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের আলোর চাহিদা মিটানো বা অন্ধকার দূর করতে এক সময় গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা ছিলো হারিকেন।
কালের বিবর্তনে, টাঙ্গাইল জেলাসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় সবার ঘর থেকে হারিকেন হারিয়ে গেছে। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটি ঘরের চিত্রটাই পাল্টে গেছে। গ্রামীণ সমাজের সন্ধ্যা বাতি হারিকেন এখন কেবল অতীতের স্মৃতি। বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম-বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে।
বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও সৌর বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। জেলার গ্রামাঞ্চলে এখন হারিকেন যেমন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তেমনি বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রামও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে হারিকেনের জায়গা দখল করে নিয়েছে সৌর বিদ্যুতের আলো বা চার্জার লাইট।
গ্রামাঞ্চলের দু-এক বাড়িতে হারিকেন পাওয়া গেলেও দেখা গেলেও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন আর কোনো ঘরে কিংবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হাজার বছরের ঐতিহ্যের বাহন সেই হারিকেন এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ এখন থেকে ২০-২৫ বছর আগেও যেখানে বেশিরভাগ ঘরেই ব্যবহার হতো হারিকেন, আর ২০ বছর পরে এসে সেইরূপ এখন পুরোটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ২০ বছর আগেও চিত্রটি ছিল এমন যে, সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে সাঁঝের বেলায় নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন সন্ধ্যায় ঘরের আলো জ্বালানো নিয়ে।
প্রতি সন্ধ্যায় হারিকেনের খুলে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ঢেলে আবার লাগিয়ে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে তা নির্দিষ্ট সীমারেখায় রেখে ঘরের মেঝে জ্বালিয়ে রাখত। ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা ও কিছুটা ছড়াকারের মত এক ধরনের কাপড় ফিতা বা রেশা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আলো কমানো ও বাড়ানোর জন্য ছিলো নির্দিষ্ট একটি গিয়ার। হাতের সাহায্যে তা ঘুরিয়ে আলো কমানো ও বাড়ানো যেতো। রাতে ঘুমানোর সময় আলো কমিয়ে সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হতো। তখন কুপি ছিল কয়েক প্রকার। একনলা, দুইনলা, একতাক, দুই তাকের, পিতল ও সিলভারের।
হারিকেনের বাতির নলে আগুন জ্বালানোর জন্য ছিলো ফিতা বা রেশা তাছাড়াও ব্যবহার করা হতো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো কিংবা পাটের সুতলি। চিকন আর লম্বা করে ৪-৫ ইঞ্চির দৈর্ঘ্যরে ওই ফিতা বা রেশা বাতির নল দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো। প্রতিদিন এর কিছু অংশ জ্বলে পুড়ে যেত। ফের পরের দিন আবার একটু উপরের দিকে তুলে দিতো। এক পর্যায়ে তা পুড়ে গেলে আবার নতুন করে লাগানো হতো। এটা ছিল নারীদের সন্ধ্যাবেলার দৈনন্দিন কাজের বিশেষ একটি অংশ পাশাপাশি ছেলেমেয়েরাও করতো।
এই বাতি দিয়ে পড়াশুনা করা হতো। এছাড়াও এই কেরোসিন তেলের হারিকেন জ্বালিয়ে রাতে সকল কাজ করা হতো যেমন- রান্না, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ধান মাড়ানো, রাতে হালচাষ, রাতে মাছ ধরাসহ সকল চাহিদা মেটানো হতো এই আলো ব্যবহার করে। হারিকেন কেবল ঘরকে আলোকিত করবার জন্যই রাখা হতো না অন্ধকারে বাড়ীর বাইরে কোথাও গেলে এই হারিকেন ব্যবহার করা হতো। তখন রাতের সাথী ছিলো হারিকেন। আলোও হতো বেশ। যদি ও এখনকার সাদা আলোর মতো নয়। তখন এই ছিলো বেশ ভালো আলো। এখন আর চোখে পড়ে না সেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেনের বাতি। শহর এলাকায় যারা বাস করছেন বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম তো এখনো চোখে দেখেনি হারিকেন। হারিকেন দেখতে কেমন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য পরবর্তী প্রজন্ম ছেলে-মেয়েদের জাদুঘরে যেতে হবে।