করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের কারণে ২৩ জুলাই হতে ১৪ দিনের সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে সরকারি বেসরকারি অফিস, আদালত ও রপ্তানিমূখী গার্মেন্টসসহ সকল শিল্প কলকারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্ত চা-শিল্পকে লকডাউনের আওতামুক্ত করে প্রায় ৫ লাখ চা জনগোষ্ঠির জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটি।শুক্রবার গণমাধ্যমে প্রেরিত সংগঠনটির জেলা কমিটির সভাপতি মো. নুরুল মোহাইমীন ও সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস এক বিবৃতিতে অবিলম্বে মজুরি-রেশনসহ চা ও রাবার-শ্রমিকদের ছুটি প্রদানের দাবি জানান।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশের গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং পরীক্ষা বিবেচনায় প্রতি ৩ জনে ১ জন করোনাভাইরাসে শনাক্ত হচ্ছে। সেরকম সময়ে দেশের ১৬৭ টি চা-বাগানের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার চা ও রাবার শ্রমিককে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকার ঘোষিত লকডাউনের প্রথম দিনেই চাঁনপুর চা-বাগানের ২ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়ি লকডাউন করে দেন।
এছাড়াও এপর্যন্ত চন্ডিছড়া, সুনছড়া, সাতগাঁও, মৃর্ত্তিঙ্গা, কালীঘাট, ভাড়াউড়া, মৌলভী চা বাগান, সাগরনালসহ বিভিন্ন চা-বাগানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মালিকরা শ্রমিকদেরকে আর পাঁচটা উৎপাদন উপকরণের মতোই মনে করেন, তাই যেখানে একটি মৃত্যুও কাম্য নয় সেখানে চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের পক্ষ থেকে চা-বাগানে করোনা সংক্রমণের হার খুবই কম এবং সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চা-শ্রমিকরা কাজ করেন জানিয়ে লকডাউনের সময় চা-বাগান চালু রাখার আবেদন করেন।
মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চা-বোর্ড ‘চা উৎপাদন’কে খাদ্য দ্রব্যের অন্তর্ভূক্ত আখ্যায়িত করে লকডাউনের আওতামুক্ত ঘোষণা দিয়ে চা-শিল্প চালু রাখার নির্দেশনা জারী করেন। চা বোর্ডের নিদেশনার সুযোগ নিয়ে চা-বাগান মালিকরা চায়ের পাশাপাশি বারার উৎপাদনও অব্যাহত রেখেছেন।
নেতৃবৃন্দ ‘চা উৎপাদন’কে খাদ্য দ্রব্যের অন্তর্ভূক্ত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চা ও রাবার জীবনরক্ষাকারী এমন কোন জরুরী পণ্য নয় যে এই দূর্যোগের মুহুর্তেও উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। মালিকপক্ষ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কথা বললেও চা-বাগানে কার্যত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বালাই নেই বললেই চলে। কোন কোন বাগানে নামকাওস্তে মাসে, দুই মাসে একবার একটি সাবান ও মাস্ক দিয়ে তাদের দায় সেরেছেন। এব্যাপারে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরেরও কোন ধরনের নজরদারি নেই।
এরকম পরিস্থিতিতে চা ও রাবার শ্রমিকদের দাবি উপেক্ষা করে মালিকগোষ্টি তাদের অতি মুনাফার মানসে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করাচ্ছেন, যার কারণে করোনাভাইরাসের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন প্রায় ৫ লক্ষ চা-শ্রমিক জনগোষ্টি। মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারও শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করছেন না।
নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা, খাদ্য সহায়তা, ঝুঁকি ভাতা, স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা দিলেও চা ও রাবার শ্রমিকদের বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকার নিরব! এমনকি চা-শ্রমিকদের টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্যও বিশেষ কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করা চা-শ্রমিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তদোপরি চা-শ্রমিকরা কলনীতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ২২২ বর্গফুটের ঘরে ৭/৮ জন গাদাগাদি করে বসবাস করেন। তাই যদি চা-বাগানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকে তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে।
যেখানে চা-শ্রমিকরা বসবাসের জন্য ন্যূনতম মাথা গোঁজার জন্য প্রাণাতিপাত করতে হয় সেখানে কোয়ারান্টাইন বা আইসোলেশনের কথা তো ভাবাই যায় না। এরকম পরিস্থিতিতে অবিলম্বে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করে মজুরি-রেশনসহ সকল চা ও রাবার শ্রমিকদের অবিলম্বে ছুটি প্রদান ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চা-শ্রমিকদের টিকা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকার গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে ৬/৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরিসহ চা-শিল্পে নৈমিত্তিক ছুটি (বছরে ১০ দিন) কার্যকর ও অর্জিত ছুটি প্রদানে বৈষম্যসহ শ্রম আইনের বৈষম্য নিরসন করে গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়ন এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মজুরি ও উৎসব বোনাস প্রদানে সকল অনিয়ম বন্ধ করে শ্রমআইন মোতাবেক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান এবং ৯০ দিন কাজ করলেই সকল শ্রমিককে স্থায়ী করার বিষয় যুক্ত করে চুড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করার জোর দাবি জানান নেতৃবৃন্দ।