প্রকাশ: ২১শে বইমেলা, ২০০৯।। (২য় পর্ব)
আমরা বিকেলের আলোয় কদম গাছের নিচে বসেছিলাম। উঠোন থেকে কদমতলে বসা পর্যন্ত ওর হাতটি আমি ধরেই রেখেছি। মাটির কোল ঘেঁষে থাকা কদম গাছের চেপ্টা পাতা বিছিয়ে বসেছি দু’জন।
হাসি ছোটছোট ঘাসফুলের স্যালোয়ার কামিজ পরেছিল। আর তাকে জড়িয়ে ছিল একটি হলুদ ওড়না। মাথা তেল মেখে আছড়িয়ে পেছনে চুলের ফুল তোলা হয়েছে। পায়ে জুতো নেই। নখে মেহেদীর রং নেই। শুধু ডানহাতের তালুতে বড় করে লেখা “মা”। তার দুই গণ্ডদেশে রক্তলাল রং আলতোভাবে ল্যাপ্টানো। এতে তার চেহারাটা ঈষৎ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। আলো আর ছায়া ওর সারা শরীরে খেলা করছে। বাতাসের তোড়ে গাছপালার হেলেদুলে নাচানে এমন সুন্দর আবহ সৃষ্টি হয়েছে। শান্ত পুকুরের জলে মাছের ছুটোছুটি আর ঘনবনে পাখিদের গান, রঙচটা বিকেলটাকে আরো সুন্দর ও স্বার্থক করে সাজিয়ে দিল। আমি আর হাসি। এখানে আর কেউ নেই।
অনেকক্ষণ তারে আপন নয়নে দেখলাম। দেখার সাধ যেন মিটছে না। সে ঝিলে ফোটা শাপলার মত চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট নেড়ে মৃদু হাসি হাসছে।
আমি বললাম, হাসি তুই খুব সুন্দর। অমনি সে ছুটন্ত ঝর্ণার মত হাসি ছড়িয়ে খুশির মিছিল বাঁধিয়ে দিল। হাসিটা ম্লান হতে না হতেই সে প্রশ্ন করে বসল—
আপনি বলেছেন গল্প করবেন। কই করছেন না যে?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কারণ যে কথাটি হাসিকে বলব ভেবেছি, তা একদম ভুলে গেছি। ওর সৌন্দর্যের মোহ কাটিয়ে কিছুটা চমকে উঠে বললাম, হাসি তোকে ধন্যবাদ। গল্পটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।
তখন সে চোখ কপালে তুলে বলল, ওমা! উঠান থেকে এখানে আসতেই সব ভুলে গেলেন!
আরে না। তুই কত সুন্দর তা চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম।
আপনি সত্যি বলেননি। আমি মোটেও সুন্দর নয়। মা আমাকে একটুও পছন্দ করে না। ভালোবাসে না। সবসময় বলে অলক্ষ্মীণী, তুই আমাদের ডুবাইবি।
আন্টি মিথ্যে বলেছেন। আসলে তুই একটা লক্ষ্মী মেয়ে। শুনেছি তোর নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?
এক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে একটু রেগে বলল, আমি জানি না।
তুই না জানলে, বিয়ে হয় কিভাবে?
এমনিতেই হচ্ছে। অনেকেই বলে না— “যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়া পড়শীর ঘুম নাই”!
আমি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলাম। তারপর বললাম, তুই তাহলে কিছুই জানিস না?
বিয়েতে মেয়েদের মতের দরকার আছে নাকি? তাহলে বাবা-মা আমাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতো। বিয়েতে আমার ইচ্ছে আছে কি নেই, জানতে চাইত। কই, কেউ তো আমাকে একটুও মূল্যায়ণ করল না।
এ ব্যাপারে আমাকে জানালি না কেন?
জানালেই বা কি হতো? আমাদের গেরামের কোন মেয়েটারে জিজ্ঞাসা করে বিয়ে দিছে? আপনি দেখানতো? মোল্লা বাড়ীর আমার বান্ধবী রুহী, উত্তরপাড়ার নাদিয়া, সোহেলের বোন শেফালীসহ সবার বিয়েই তো এভাবে হয়েছে। ওরা নিজের মুখে আমাকে সব বলেছে। এর দায় কার? আমরা মেয়েরা এত অসহায় কেন? আমাদের অসম্ভব সুন্দর স্বপ্নগুলো নীরবেই ঝরে যাচ্ছে। আমরা হেরে যাচ্ছি পুরুষ শাসিত সমাজের ভ্রান্ত নিয়মের কাছে। সবাই বলে মেয়েদের নাকি বেশি পড়ালেখা করতে নেই? তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলেই মঙ্গল।
এখন বল, তোর বর দেখতে কেমন?
একদম ভালো না। একটা পেট মোটা দৈত্যের মত লাগে। একটু সুন্দর করে কথাও বলতে পারে না। বয়স কম করে হলেও ৫০/৬০ বছর তো হবেই। যখন আমি তার সামনে যাই, মাথা উঠিয়ে এক পলক দেখতেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছে বড্ড বিরক্তও লেগে উঠল। ইচ্ছা হয়েছিল, ঢিসুম মেরে নাকটা ফাটিয়ে দিই। কিন্তু পারলাম না। আমরা এভাবেই হেরে যাই। আমাদের সুন্দর স্বপ্নগুলোও নীরবে নিঃশেষ হয়ে যায়!
হাসির কথা শুনে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েটির ইচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের বিন্দু মাত্রও দাম দেয়া হল না। বলেছে, ছেলে নাকি বড় লোক। আবার ৫০ হাজার টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে চায়। নির্লজ্জ বেহায়ার দল কোথাকার।
শ্রাবণের মেঘলা আকাশের মত সে শান্ত হয়ে গেল। বড্ড চুপচাপ একটা থমথমে ভাব বিরাজমান। মনে হচ্ছে, একটু পরই ঝড় আসবে, বৃষ্টি নামবে।
হাসিকে শান্ত্বতার সুরে বললাম, তুই একটুও চিন্তা করিস না লক্ষ্মীটি। এই বিয়ে হবে না। আমি এই বিয়ে হতে দেব না। তোর সুন্দর স্বপ্নগুলো ভেঙেচুরে তছনছ হতে দেব না আমি। ওদের নীল আকাশে উড়তে তাদের পিঠে আমি নীল ডালা লাগিয়ে দেব। ওরা উড়বে সারা আকাশে। আমি তোর স্বপ্ন পূরণে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর মত সবসময় পাশে আছি, পাশে থাকবো।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল অসহায় ও নিরপরাধ ফুলের মত মেয়ে হাসি। তার কান্নার শব্দটা একটুও শোনা গেল না। তবু তার নীরব কান্নাই আমার বুক ভাসিয়ে দিল। অঝর ধারায় বইতে লাগলো অশ্রুর বান।
চলবে….