কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই লাইন দুটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই বাঙালির নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অমর ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে সেই ইতিহাসের কিংবদন্তী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের মধ্যে, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা, সাহস এবং উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু এবং সহযোদ্ধা।
বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অর্জনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গমাতার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন এমন এক প্রেরণাদাত্রী, আপোষহীন, দূরদর্শী, কষ্টসহিষ্ণু, প্রত্যয়ী, নিরহংকারী, বাঙালি আদর্শ বধূ এবং মায়ের প্রতিচ্ছবি যিনি বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজের সব কষ্টকে জয় করেছেন কিন্তু নিজে কোনদিন পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চাননি। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্ত্রী করেটা স্কট কিং, ফ্রাঙ্কলিক রুজভেল্টের স্ত্রী ইলিয়ানর, জুয়ান পেরোনোর স্ত্রী ইভা পেরোন, নেহরু পত্নী কমলা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের পত্নী বাসন্তী দেবী, নেলসন ম্যান্ডেলা পত্নী উইনি যেমন তাঁদের কর্মগুণে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন, ঠিক একইভাবে ইতিহাসে চির ভাস্বর থাকবেন বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, যাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রচেষ্টাই বঙ্গবন্ধুর ‘জাতির পিতা’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি কাজ করে গেছেন নিরলস। এজন্য তাঁকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, করতে হয়েছে অনেক আত্মত্যাগ দেশ ও জাতির জন্য তাঁর অপরিসীম ত্যাগ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতা তাঁকে অভিষিক্ত করেছে বঙ্গমাতায়; হয়েছেন তিনি নারী সমাজের প্রেরণার উৎস।
‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী” তে বঙ্গবন্ধু এই বিষয়ে লেখেছেন, “রেনু খুব কষ্ট করতো কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা যোগাড় করে রাখতো যাতে আমার কষ্ট না হয়”। স্বামীর প্রতি দায়িত্ববোধের সঙ্গে এখানে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে সীমান্তে শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মাতৃ-গর্ভে। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেগম মুজিব অন্য অনেকের মতো স্বামীকে নিজের পাশে থাকতে অনুরোধ না করে বরং দেশের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন।
তিনি সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।’ এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির জন্য, মানুষের জন্য কাজ করার জন্য অনেক বড় প্রেরণা।
মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বারংবার জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে কিন্তু একটিবারের জন্যও ভেঙে পড়েননি সর্বংসহা বেগম মুজিব। অনাহার-অর্ধাহার- রাজনৈতিক রোষানলে পরিবার নিয়ে জর্জরিত বেগম মুজিব সাহস হারাননি কখনো। বঙ্গবন্ধুর কারারুদ্ধ দিনগুলোতে প্রয়োজন মেটাতে অলংকার, ঘরের আসবাবপত্র বিক্রয় করতে হয়েছিল তাঁকে।
উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি নিজ ভোগের পরিবর্তে ব্যয় করেছেন সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পেছনে। বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দী কালীন মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত ও আন্দোলন পরিচালনা করা এবং পরিবারের সদস্যেদের প্রতি খেয়াল রাখাসহ প্রতিটি কাজ তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে সম্পন্ন করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে সাংকেতিক ভাষায় জানাতেন আন্দোলন-সংগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি এবং নিয়ে আসতেন নেতাকর্মীদের জন্যে সার্বিক নির্দেশনা।
ছাত্রলীগের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দূরই শুধু তাই নয়, দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েও নিজের গহনা বিক্রি করে তিনি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরও আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে দিতেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর মনোবল যেন ভেঙ্গে না পড়ে সেদিকে বেগম মুজিব ছিলেন সচেষ্ট। কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও যৌবনের কিছু কথা লিখে যাওয়ার তাগিদ তিনি অনুভব করেছিলেন। তাই স্বামীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে লিখে রাখতে। তাঁর অনুপ্রেরণার কল্যাণেই আজ বাঙালি জাতি পেয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক অসাধারণ মানবিক ও রাজনৈতিক অমর উপাখ্যানের দুটি গ্রন্থ।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফা আন্দোলন সারাদেশে জাগরণ তুলে ফেললে সামরিক স্বৈর শাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করেন। সেই সময় বোরখা পরে বিভিন্ন স্থানে ছয় দফা কর্মসূচী ভিত্তিক লিফলেট বিতরণ করেছেন এই নীরব বিপ্লবী কর্মী। ছয়দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনে আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদ টলে যাওয়ার উপক্রম হলে বঙ্গবন্ধুসহ পঁয়ত্রিশজন নেতার নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। সাধারণত পান-সুপারি-মসলা সাজানো পানের বাটা হাতে, আঁচলে এক গোছা চাবি, বাংলার নারীর এমন স্নিগ্ধ রূপটিই আমরা বঙ্গমাতার মধ্যে দেখতে পেলেও আগরতলা মামলা চলাকালীন প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব ও দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার। তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি দিলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই ছিলেন নির্ভয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে প্রবল আন্দোলন রুপ নেয় গণ অভুত্থানে। আইয়ুব খান দিশেহারা হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রলোভন দেখায়।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা সেই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে বেগম মুজিবকে প্রস্তাব মেনে নিতে অনুরোধ জানালেও তিনি সরাসরি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। বড় মেয়ে ও জামাতাকে ক্যান্টনমেন্টে পাঠালেন চিরকুট নিয়ে। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে।’ বঙ্গমাতার সেই পরামর্শ মেনে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। গণ আন্দোলনের চাপে জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিল। সেই সঙ্গে বাধ্য হলো ‘ওয়ান মেন ওয়ান ভোট’ মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে। এর মধ্য দিয়েই তরান্নিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার গতি। বঙ্গমাতার সেদিনের এই একটি সিদ্ধান্ত ছিল বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের আলোকিত পথ নির্দেশিকা।
ঐতিহাসিক সাতই মার্চে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল নতুন আলোকের দিশা। ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলছিলেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলির জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয়তমা সহযোদ্ধার পরামর্শ মোতাবেক তাই করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পুরো জাতিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সংগ্রামে। তেইশে মার্চ বাংলার ঘরে ঘরে উড্ডীয়ন করা হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। ঐদিন বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন,‘তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।” বিচক্ষণ এই মহীয়সী নারী এভাবেই বাঙালির মনের কথা নিজের বুকে ধারণ করেছিলেন।
উত্তাল মার্চে বাংলার মানুষের ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নেবিভোর বঙ্গমাতা হাসিমুখে সামাল দিয়েছিলেন সেই বিপুল জনতার খাওয়া পরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে তিনি মোকাবেলা করেছেন বৈরি পরিস্থিতি। একদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, দুই ছেলে শেখ জামাল এবং শেখ কামাল জীবন বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে,অন্যদিকে ঘরে সন্তান সম্ভাবা কন্যা শেখ হাসিনা, শিশুপুত্র রাসেলসহ গৃহবন্দি তারপরও তিনি বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে প্রতিমুহূর্তে দেখে গিয়েছেন বিজয়ের স্বপ্ন।
কাঙ্খিত সেই বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও বঙ্গমাতার অনিচ্ছার কারণে রাষ্ট্রীয় বাস ভবনে উঠালেন না। তাদের সেই পুরোনো ঠিকানা বত্রিশ নম্বরের বাড়ি। ক্ষমতা তাঁকে কক্ষচ্যুত,মোহবিষ্ট করতে পারেনি। বঙ্গমাতা সেই বঙ্গমাতাই। তাঁর ভেতরে আসেনি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন। আগেও যেমন মোটা পাড়ের শাড়ি পরতেন, ফার্স্ট লেডি হয়েও তাই। আগের মতোই সেই সাধাসিধে জীবনযাপন। বঙ্গবন্ধু কোনো অনুষ্ঠানে জোর করে নিয়ে গেলেও সেখানে যেতেন সাদামাটা ভাবে। কোনো বিদেশি মেহমান এলেও তাকে দেখে অবাক হতেন। বিনয়ী, নির্লোভ ও নিরহংকারী মহীয়সীর এই জীবনধারাই তাঁকে আদর্শ বঙ্গমাতারুপে বাঙালির মনে আসীন করেছে। ঝাঁপিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। বিশেষ করে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়া সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন তিনি।
দেশপ্রেম, সাহস, বিচক্ষণতা, দূরদর্শীতা, বলিষ্ঠ মনোভাব, নির্লোভ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বপরায়ণতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা সহ মানবিক সকল গুণাবলির অধিকারী বঙ্গমাতার সহযোদ্ধারুপে আবিভ’ত হওয়ার কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাঙালির ইতিহাসে হয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্মরণীয় এক নাম।