বৃষ্টি ঝরছে এখন।হয়ত অগণিত অসংখ্য লাশও ভিজছে আপন আঙিনায়।বৃষ্টির পূর্বে রাখা লাশ এখন বাড়ির উঠোনে ভিজছে। বৃষ্টি আসার পর সবাই আশ্রয় নিয়েছে দৌড়ে গিয়ে ঘরে বা বারান্দায়।একদিন তাদের মত দৌড়াতে পারা লাশ হওয়া মানুষটি আর দৌড়াতে পারছে না।একাকীই ভিজছে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে।আপন বউ বা স্বামী, সন্তান, ভাইবোন সবাইই আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত।আমার বাড়ির উঠোনে বৃষ্টির জলের বাণ উঠেছে।টিনের চালে বেদনার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা শীতল বৃষ্টি ঢেউটিনের ঢেউয়ের পথ ধরে সারিবদ্ধভাবে উঠোনে ঝরছে।এ যেন স্বজন হারানো সকল মানুষদের সম্মিলিত অশ্রুপাত!
কাদা ও শেওলায় ভরা উঠোনে একদিন আমিও হয়ত লাশ হয়ে এই উঠোনেই ভিজব। আমার তপ্ত হৃদয় শীতল হবে বৃষ্টির বর্ষণে। সেদিনও বৃষ্টি আসার পর আমাকে ছেড়ে সবাই আশ্রয় নেবে আপন গৃহে। পড়ে রইব আমি একা বৃষ্টিভেজা লাশ হয়ে। এমন অবস্থা সবারই হবে ভাই। আপনার প্রাণবায়ুটা দেহ থেকে উড়াল দেয়ার পরই আপন সবাই হয়ে যাবে পর। আপনি হয়ে পড়বেন মূল্যহীন। হুমড়ি খেয়ে পড়ে কলিজার টুকরো খোকাখুকিসহ অন্যান্যরা মরহুমের নামের ব্যাংক একাউন্ট তালাশ করবে। সম্পদের ভাগবাটোয়ারা কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিতে তৎপর হবে। দুইচার দণ্ড সময় আপনাকে আঙিনায় ফেলেই ওরা ওইসব পার্থিব সম্পদ ও ভোগবিলাসের হিসাব মেলাবে হৃদ গহীনে। যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে আমাকে মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে পরম আপন মানুষগুলোও হয়ে পড়বে বড্ড অচেনা। দুই চারজন ভাগ্যবান মানুষদের স্ত্রী সন্তানরা তাদের জান্নাতবাসের জন্য দোয়া করবে। অধিক সংখ্যক মানুষের জন্য কেউ দোয়া করবে না, কেউ ক্ষমা চাইবে মহান আল্লাহর কাছে। পার্থিব সুখে আর মায়াবী ভোগবিলাসে ডুবে ওরা ভুলে যাবে নিজেদের সৃষ্টিকর্তাকেও!
আহা! কি করুণ বিষয়। কি হৃদয়বিদারক বাস্তবতা! কত সহজে হৃদ গহীনে রাখা আপনজন পর হয়ে যায়! যে ভালোবাসার মানুষের জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দেয়, সে ভালোবাসার মানুষও নতুন কাউকে সঙ্গী করে নেয় খুব সহজে। আপন ভালোবাসার রেখে যাওয়া স্মৃতিরত্ন কাচের গ্লাসের মত ভেঙে চুরে বিচূর্ণ করে গড়ে নেয় নিজের স্বার্থান্বেষী ভালোবাসার আরেকটি তাজমহল। সুনীল আকাশ, অক্সিজেন ভরা বিশুদ্ধ বাতাসও এ সময় নীরব নিথর হয়ে পড়ে। গুমরে কাঁদে মানবতার নির্মল স্বত্বা। তবু আমরা আশা রাখি, স্বপ্ন বাঁচাই নির্মল আগামীপূর্ণ একটি সুন্দর সকালের অপেক্ষায়। কেউ কি বলতে পারেন, এ অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে? হয়ত পারবেন না! কয়েক মুহূর্ত ভেবে আপনার খোলা মন ক্লান্ত হয়ে পড়বে। দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়ে উঠবে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা। তবু আমাদের বাঁচতে হবে। তবু আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। তবুও আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে— মানবতার সূর্যের বিজয় আনার জন্য।
করোনার দখলে সারা পৃথিবী। মহাপরাক্রমশালী সুমহান আল্লাহর ইচ্ছায় করোনার এ রাজত্বে সকল ক্ষমতা নিষ্ক্রিয়। পারমাণবিক বোমার বাটনের এক চাপে যে জল্লাদটি হাজার হাজার মানুষকে খুন করতে পারত, সেও আজ লাশ হয়ে মাটিতে শুয়ে গেছে। আজ সে বিলীন অস্তিত্বহীন। ক্ষমতার ঢাকঢোল বাজিয়ে সারা পৃথিবীকে সদা সর্বদা ভয়ে নিমজ্জিত রাখা আমেরিকা, চীন, রাশিয়া শোকে হতবিহ্বল, ভয়ে কাতর। প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের সর্বত্র ভয়াল করোনা— তাণ্ডব চালাচ্ছে। এ্যাম্বুলেন্সের ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, আবারও এ্যাম্বুলেন্সের গুমরে কাঁদার প্রচণ্ড আর্তানাদে ঘুম ভাঙে আমাদের। একের পর এক লাশ হওয়া, স্বজনদের আকাশ-বাতাস ভারী করে বুক ভাঙা বিলাপ, হাসপাতালের প্রতি ইঞ্চি জায়গায় মৃত্যু পদযাত্রী মানুষের আর্ত চিৎকার, সন্তান হারা, ভাইহারা, বোনহারা হাজার হাজার মানুষের আহাজারিতে আমার সোনার বাংলা আজ শ্মশানপুরী। একের পর এক জানাযার আহবানে মোচড় মারা হৃদয় কাঁদে নীরবে নিভৃতে। চারপাশে শুধু হারানোর গল্প, বিলাপের ঝড়, মৃত্যুর দৌড়ঝাপ। কঠোর লকডাউন অতি কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পরও আক্রান্তের হার শতকরা ৫০ ভাগ ছুঁইছুঁই!
সরকার ও জনগণের সম্মিলিত আন্তরিক প্রয়াসে তবু আমাদের এ যুদ্ধে জিততে হবে। ভয়াল করোনাকে হারাতে হবেই আমাদের। আলাদা থেকেও কর্মে, ঐক্যে, সমর্থনে, সহযোগিতায় এক হয়ে হারাতে হবে করোনাকে। অগণিত অজস্র ডাক্তার-নার্সদের জীবন-মরণ এ লড়াইয়ে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনসচেতনতার লড়াইয়ে, সরকারের দেয়া ত্রাণ সহায়তায় ক্ষুধার লড়াইয়ে— আমাদেরকে জিততে হবে। সব বাঁধা বিপত্তি পদদলিত করে, আমাদের যেতে হবে নতুন ভোরের কাছে। সব আঁধার তাড়িয়ে আনতে হবে আলোর ভোর, মুক্তির ভোর, মানবতার ভোর, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভোর, ক্ষুধা মুক্ত, অকাল মৃত্যু মুক্ত, বিরামহীন অশ্রুসিক্ত হয়ে প্রচণ্ড আর্তনাদ মুক্ত একটি সুন্দর ভোর।