স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে যে কয়জন ফুটবল খেলোয়ার একুশ শতকে এসেও আজও আম -জনতার হৃদয়ের মনিকোঠায় সমুজ্জ্বল তাদের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ও বাংলাদেশের জননন্দিত ক্লাব আবাহনীর সাবেক অধিনায়ক মোনেম মুন্না অন্যতম । বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে যিনি কিংব্যাক মোনেম মুন্না নামে খ্যাত । ক্ষণজন্মা এই ফুটবল খেলোয়ার এর অনন্য ফুটবল শৈলী এবং দ্যুতি দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে ও ছড়িয়ে পড়েছিল । ভারতের লীগে তিনি খেলতেন জনপ্রিয় দল ইস্টবেঙ্গল এর পক্ষে । বাংলাদেশের মতো সেখানে ও তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয় । কিডনি ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এই বসুন্ধরা ত্যাগ করা মুন্না ভাই আজও আমার স্মৃতিতে চিরজাগরুক ।
সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৯৫ সাল । ঢাকা লিগের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রিয় দল আবাহনী মুখোমুখি তৎকালীন জায়ান্ট কিলার ইয়ংমেন্স ফকিরাপুল ক্লাবের । খেলার দিন ” দৈনিক বাংলাবাজার ” পত্রিকা মারফত জানলাম প্রচন্ড জ্বর থাকায় আজ খেলতে পারবেন না মুন্না ভাই । আবাহনীর পাড় সমর্থক হিসেবে মনটা বেদনায় ভরে উঠলো । মুন্নাভাই ব্যতীত আবহনী মহা গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে কি করে – সেই টেনশন করতে করতে সন্ধ্যায় ছয়টায় পাঠ্যবই সামনে রেখে( আমাদের রিডিং রুম ছিল দুই তলায় , সৌভাগ্যবশত সেদিন বাসার মুরুব্বীরা নিচ তলায় অবস্থান করছিলেন ) বাসায় থাকা থ্রি ব্যান্ডের রেডিও তে খেলার ধারা বিবরণী শুনতে মনোযোগী হলাম লো ভলিউমে । ইথারে ভেসে আসলো সেই বিখ্যাত জনপ্রিয় ধারা ভাষ্যকার শ্রদ্ধেয় মরহুম খোদাবক্স মৃধা ভাইয়ের ভরাট ও প্রাঞ্জল কণ্ঠ । তিনি অপর জনপ্রিয় ধারা ভাষ্যকার মঞ্জুর হাসান মিন্টু ভাইকে বলছিলেন মুন্না ব্যতীত আজ আবাহনী কি পারবে জায়ান্ট কিলার ইয়ংমেন্স এর বিপক্ষে ….? খেলা শুরু থেকেই ইয়ংমেন্স একের পর এক আক্রমণ এ দিশেহারা আবহনীর রক্ষণ দুর্গ । আক্রমণ তোর দূরে থাক ইয়ংমেন্স এর আক্রমণ সামলাতেই তটস্থ আবাহনীর ডিফেন্ডাররা ।
ধারাভাষ্যকাররা বলতে থাকলেন আজ মুন্নার অভাব হারে হারে অনুভূব করছে আবাহনী , ইয়ংমেন্স এর প্রতিটি আক্রমণে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের সমর্থকরা গলা ফাটিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল । প্রথমার্ধের শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে খুব সম্ভবত ইয়ংমেন্স এর তরুণ ফুটবলার আল-আমিন গোল করে বসে আবাহনীর বিপক্ষে । রেডিওর অপর প্রান্তে থাকা আমার অবস্থা তখন কুল হারা নাবিকের মতো । দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুতে বেশকিছু আক্রমণ আবাহনী করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি উপরন্ত খেলা শেষের ২৫ মিনিট পূর্বে দ্বিতীয় গোল হজম করে বসে আবাহনী। গোল হজমের পর ধারাভাষ্যকাররা বলতে লাগলেন আবাহনীর গ্যালারি ” মুন্না ” মুন্না ..স্লোগানে প্রকম্পিত ।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবাহনীর বিপর্যয় রুখতে এবং সমর্থকদের দাবি মেটাতে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বদলি হিসেবে মাঠে নেমে পড়লেন মুন্না । তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়লো গ্যালারি । রেডিওর অপরপ্রান্তে আমিও ব্যাপক উল্লসিত । মুন্নাভাইয়ের মাঠে নামার ফলশ্রুতিতে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় যেন জেগে উঠল গ্যালারি সহ আবাহনীর সকল খেলোয়াড়রা । মুন্না ভাইয়ের একের পর এক ডিফেন্স চেরা পাস এ তখন তটস্থ ইয়ং মাংসের রক্ষণভাগ । মাঠে নামার খুব সম্ভবত ৮-১০ মিনিটের মধ্যে মুন্নাভাইয়ের এসিস্টে প্রথম গোল করে আবাহনী । সম্ভবত গোলাম গাউস ভাই গোলটি করেছিলেন । উল্লাসে এত জোরে চিৎকার করে ছিলাম যে আমার মা বাসার নীচ তলা থাকে উপরে ছুটে এসেছিলেন । ছেলের পাগলামি দেখে তিনি আর কিছু বলেননি বরং খেলা শেষে পড়া শেষ করতে বলেছিলেন । লাইসেন্স পেয়ে রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিলাম সর্বোচ্চ ।
ধারাভাষ্যকার খোদা বক্স মৃধা ভাই বারবার বলছিলেন আর মিনিট পাঁচেকের মত খেলা বাকি আছে আবাহনী কি পারবে গোল শোধ করতে …?? চরম উত্তেজনা ভর করল আমার উপর । খেলা শেষের ২ মিনিট পূর্বে ইয়ংমেন্সের ডি-বক্সের বাইরে থেকে প্রাপ্ত ফ্রি-কিক হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন মুন্না ভাই । খুব সম্ভবত আবাহনীর মামুন জোয়াদ্দার অথবা রঞ্জন অথবা রিজভী করিম রুমি ভাই ( এখন সঠিক মনে পড়ছে না ) হেড দিয়ে আবাহনীর পক্ষে গোল করে ২-২ গোলে সমতা আনেন । মুন্না ভাইয়ের জন্য ধারাভাষ্যকারদের স্তুতি বাক্য এবং আমার তুমুল উল্লাসের এর মধ্যে দিয়ে কখন যে খেলা শেষ হল টেরই পেলাম না । কাল বিলম্ব না করে মুন্না ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা মাখানো ভালোবাসা নিয়ে সেদিন পাড়ায় নেমে মোহামেডান এর পাড় সমর্থকদের খেপাতে লাগলাম । পরবর্তীতে চট্টগ্রাম লিগে মুন্না ভাই খেলতে আসলে উনার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল । মুন্নাভাই সম্পর্কে জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন ……. ” He is born in Bangladesh was a mistake . ” অর্থাৎ মুন্নাভাই ভুল করে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ।
মুন্না ভাই বিগত হয়েছেন ১৭ বছর পূর্বে । বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন অর্থাৎ বাফুফে কিংবদন্তি এই ফুটবল প্লেয়ারের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন কিংবা তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ও আজও আমাদের মত হাজারো ভক্ত সমর্থকদের হৃদয়ে তিনি চির জাগরুক হয়ে আছেন শ্রদ্ধা মেশানো ভালোবাসার সংমিশ্রণে ।
লেখক : তানভীর আহমেদ ( গণমাধ্যমকর্মী )