প্রদীপ কুমার দেবনাথ : স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ,ডিজিটাল বাংলাদেশ,উন্নয়নের রোল মডেল খ্যাত আমাদের এই সোনার বাংলা। ১৯৭১ সালে ১৬ ই ডিসেম্বরে রক্তস্নাত ধ্বংস্তুপে ভূমিষ্ট হওয়া বাংলাদেশ নামক শিশুটির বয়স এখন ৫০ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুরই। উন্নতি ও হয়েছে ব্যাপক। তবে যে খাতগুলোর উন্নয়ন হলে আজ আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারতো তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রে আসে শিক্ষা খাতের নাম।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই ভাবিনা কেন সুশিক্ষার ফল কিন্তু সুদূরপ্রসারী। আর কোন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় নিয়ামক সুশিক্ষিত জাতি। বাঙ্গালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের অগ্রাধিকার পাওয়া খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাত ছিল অন্যতম। ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার আগে স্বল্প সময়ে তিনি শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। অভাবে জর্জরিত ধ্বংসস্তুপের উপরেই তিনি ১৯৭২ সালে ৩৬ হাজার ১৫৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি সময় পেলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরকেও জাতীয়করণ করে যেতেন।
তিনি তখনই অনুধাবন করেছিলেন একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শিক্ষাব্যবস্থাকেও অনেকাংশে হত্যা করা হয়েছে পরবর্তীকালে। পুরোপুরি অবহেলার মাধ্যমে শিক্ষার হার বাড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেধাশূণ্য শিক্ষিত তৈরি হয়েছে। মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও উচ্চশিক্ষায় চলছে ইঁদুর বিড়াল খেলা। আজ এটাতো কাল ঐটা। এই শিক্ষকদের হাতে তৈরি করা বড় বড় চেয়ারে বসা কর্তাগণ একপ্রকার পুতুল খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে জাতির এ মহান কারিগরদের নিয়ে।
এক সময় যারা শিক্ষকদের মুখের দিকে চেয়ে থাকত মূল্যবান কিছু কথা শিখবার জন্য, যারা ভাবত বড় হয়ে এ মহান কারিগরদের জীবন মান পরিবর্তনের জন্য কিছু করবে তারা আজ কর্তার চেয়ারে বসে অসহায় শিক্ষকদের উপহাস করে যাচ্ছে নিয়মিত। তাদের হঠকারিতা শিক্ষকদের নিম্ন শ্রেণির মানুষের চেয়েও নগন্য হিসেবে পরিণত করেছে। শিক্ষকদের কোন দাবি তারা সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে আগ্রহী নয়। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে শোষিত ও অবহেলিত পেশার নাম শিক্ষকতা। হয়তো অনেকেই চেষ্টা করবেন আমার কথাটিকে খণ্ডানোর জন্য।
কেউ কেউ নানা যুক্তি দাড় করাবেন। কিন্তু ভেবেছেন কি – এমপিওভুক্ত বেসরকারি-শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতার কথা? তাদের বোনাস, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার কথা? নিশ্চয়ই জানেননা বা ভাবেননা। শুধু দায়িত্ব পালনের জন্য তাগিদ দেন। বুঝা উচিত তাদেরও পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সমাজ আছে। তাদেরও চাহিদা আছে। সর্বোপরি তারাও মানুষ। তাদেরও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হয়, ছোট ভাইবোনদের চাহিদা পূরণ করতে হয়। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি উচ্চমূল্যের বাসা-ভাড়া, বাড়ন্ত বিদ্যুৎ-গ্যাসবিল, চিকিৎসা ও শিক্ষা-খরচ এসব কি করে পূরণ করা সম্ভব?
একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ১২হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান অপরদিকে একজন পিয়ন বা পুলিশ কনস্টেবল কোনরকমে এসএসসি পাশ করে ৩০/৩৫ হাজার টাকা বেতন পান। যা শিক্ষক সমাজকে শুধু অপমান নয় রীতিমতো তাচ্ছিল্য করা হয়। এদেশে একজন পিয়নের সাত তলা ভবনের বাড়ি আর অনেক শিক্ষক গৃহহীন, ভূমিহীন নিঃস্ব। পেটের চাহিদা পূরণে যিনি রাতদিন পরিশ্রম করেন তার নিকট সর্বোচ্চ সার্ভিস আশা করাটা হাস্যকর নয় শুধু বোকামিও বটে। দোকান বাকী, ঔষধের বিল বাকী, চালের দাম বাকি, বাসা ভাড়া বাকি, সুদখোরদের সুদ বাকি, কিস্তির টাকা বাকি, ডাক্তারের ফি বাকি রেখে যিনি ফেরারি হয়ে পালিয়ে বেড়ান তার দ্বারা সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রদান কখনোই সম্ভব নয়।
খোঁজ নিলে এ অবস্থা পাওয়া যাবে প্রায় ৮৫% শিক্ষকের ক্ষেত্রে। বহুকষ্টে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষকগণ আজ বড় অসহায়। অনেকেই শিক্ষকদের যৌক্তিক বেতনের কথা বললে ভিন্নমত দেন। এর কারণ স্পষ্ট। এরা হয় মূর্খ নয় শোষক। প্রকৃত ও বাস্তবমুখী শিক্ষা, মেধাবী শিক্ষক ও মেধাবী শিক্ষার্থী পেতে হলে জাতির বিবেকদের দৈন্যদশা ঘুচাতে হবে। জাতীয় বেতনস্কেলে সরকারি বিধি অনুসারে বেতন-ভাতাদি প্রদান করতে হবে, করতে হবে জাতীয়করণও। অন্যথায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন আলোর মুখ দেখবে না কখনো।
লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যম কর্মী।