ফয়সাল আহমেদ: রূপগঞ্জ এখন মাদক আর চোরাচালানের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। তার সাথে রয়েছে অন্য কোথাও মানুষ মেরে লাশ ফেলার নিরাপদ স্থান। প্রতিনিয়তই রূপগঞ্জের কোথাও না কোথাও লাশ পাওয়া যাচ্ছেই। র্যাব পুলিশের পাহাড়াও এদেরকে থামাতে পারছে না। দুঃখের বিষয় প্রশাসন কিছুই করতে পারছে না। অপরাধীরা কাজ সেরে বীরদর্পে নিরাপদেই ফিরে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগন এসব বিষয়ে আতঙ্কিত। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠের উপজেলা রূপগঞ্জ থেকে চলতি বছরের ৬ মাসে ২১ টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। চলতি বছরই নয়, প্রতি বছরই রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। ধীরে ধীরে অজ্ঞাত লাশের নিরাপদ ঠিকানা হয়ে উঠছে রূপগঞ্জ। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে হত্যার পর লাশ সুযোগ বুঝে রূপগঞ্জে ফেলে যাচ্ছে। রূপগঞ্জের অনেক এলাকা দুর্গম হওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন প্রশাসন ও রূপগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের তিনদিনে মিলেছে ৩ লাশ। লাশ পাওয়ার খবর শুনে-শুনে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রূপগঞ্জবাসী। নীরব-নিস্তবব্ধ থাকার কারণে পূর্বাচল উপশহর ও শীতলক্ষ্যা নদীকে লাশ ফেলার নিরাপদ ঠিকানা হিসাবে বেছে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয়দের দাবী, লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তদন্তে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। তদন্তও আগায় না।
নিরাপত্তাও জোড়দার করা হয় না। গত কয়েক বছরের লাশ উদ্ধারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, উপজেলার ১৫ টি পয়েন্ট লাশ ফেলার নিরাপদ ঠিকানা হিসাবে বেছে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
গত ২৭ জুন শনিবার নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। এ সময় পুলিশ প্রায় ১৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৫০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকারও বেশি। রূপগঞ্জ থানাধীন গাউছিয়া টু ঢাকা সড়কের পাশে কাঞ্চন টোল প্লাজায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ এই অভিযান পরিচালনা করে।
রোববার (২৮ জুন) দুপুরে জেলা পুলিশের কার্যালয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলমের প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে র্যাব ১ সিপিপি ৩ এর টিম একই স্থানে অভিযান চালিয়ে গাজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন চোরাই মালামাল উদ্ধার করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, ডুমনী থেকে অটোরিক্সা করে খিলক্ষেত যাওয়ার
পথে ৩০০ ফিট গেলে একটি মাইক্রোবাস এসে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে যাত্রীকে তুলে নিয়ে যায়। পূর্বাচল উপশহরে নির্জন জায়গায় হাত পা বেঁধে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় ভুয়া ডিবি পুলিশ। পরে ওই চক্র, পূর্বাচল উপশহরে এক অটোরিক্সা (ইজিবাইক) চালককে মেরে লাশ ফেলে যায়।
এ বিষয়ে র্যাব ১ সিপিসি ৩ এর কমান্ডার মেজর আব্দুল্লাহ আল মেহেদী বলেন, পূর্বাচল র্যাব ক্যাম্প থেকে সার্বিক নজরদারি করা হচ্ছে। মহাসড়কে সক্রিয় অপরাধী চক্রকে ধরতে সজাগ রয়েছি আমরা। বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদক ও চোরাচালান রোধে আমরা তল্লাশি অব্যাহত রেখেছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমে বালু নদী ঘেঁষা রাজধানী ঢাকা। পূর্বে আড়াইহাজার ও সোনারগাঁও। উত্তরে গাজীপুর। আর দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ-সোনারগাঁও। এসব এলাকার সঙ্গে রূপগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব সহজ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রূপগঞ্জে যাতায়াতের সড়ক রয়েছে ৭ টি। এদের মধ্যে চিটাগাং রোড-কাঁচপুর হয়ে রূপগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী-ষ্টাফ কোয়ার্টার হয়ে রূপগঞ্জ, মেরাদিয়া- আমুলিয়া হয়ে রূপগঞ্জ, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী হয়ে রূপগঞ্জ, বাড্ডা-মাদানী নগর-বেড়াইদ হয়ে রূপগঞ্জ, ডুমনী-পাতিরা হয়ে রূপগঞ্জ, কুড়িল বিশ্বরোড হয়ে রূপগঞ্জ ও ডেমরা-চনপাড়া হয়ে রূপগঞ্জ সড়ক। এসব সড়কগুলোর মধ্যে চিটাগাং রোড-রূপগঞ্জ ও ষ্টাফ কোয়ার্টার-রূপগঞ্জ
সড়কটি দিন-রাত যানবাহন চলাচল ও ব্যস্ত থাকলেও বাকী সড়কগুলো রাত নেমে আসলেই নেমে আসে নীস্তব্ধতা। নির্জন-নীরব এসব সড়ক দিয়ে লাশ, মাদক বহন থেকে শুরু করে সব ধরণের অপকর্ম ঘটে থাকে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এসব সড়কে পুলিশের কোন চৌকি নেই বলেও জানা গেছে। এছাড়া বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটে থাকে। এ দুই নদীতে
পুলিশের নৌ-টহলের কোন ব্যবস্থা নেই।
অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সময়ে লাশ উদ্ধারের ঘটনা সমীক্ষা করে দেখা গেছে, রূপগঞ্জের ১৫ টি স্থান থেকে বিভিন্ন সময়ে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাচল উপশহর ও শীতলক্ষ্যা নদীকে দৃর্বত্তরা নিরাপদ স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি লাশ এসব এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আধুরিয়া, কর্ণগোপ, বালু নদী, কায়েতপাড়ার ছনেরটেক-দেইলপাড়-চনপাড়া সড়ক, জিয়সতলা, এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের ছেলুরবাড়ি, পলখান , পূর্বাচল উপশহরের ৮, ৯ নম্বর সেক্টর ও ৩শ’ ফুট সড়ক ও দাউদপুর-ভোলাবো ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা-বিলঝিল।
থানা পুলিশ, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, গত ৬ মাসে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২১ টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটির পরিচয় মিললেও বাকীদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। গত ১৩ ফেব্রুযারী শীতলক্ষ্যা নদের নোয়াপাড়া বটতলা খেয়াঘাট থেকে অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ৬ মার্চ কাঞ্চন এলাকা থেকে সুরভী আক্তার নামে এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদের মুড়াপাড়া বাজার ঘাট এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা পুরুষ ও বাউলিপাড়া
এলাকার ঘাট থেকে আরেক অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত ৯ এপ্রিল পূর্বাচল উপশহরের ১৮ নং সেক্টর থেকে শামীম নামে এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি সপ্তাহের পহেলা জুলাই কায়েতপাড়ার কোটাপাড়া বিল থেকে তরুণের লাশ ও চনপাড়া পূর্নবাসন এলাকা থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত গত ২ জুলাই কাঞ্চন কুশাব এলাকায় ড্রামের ভেতর থেকে ব্যবসায়ী হেকমত আলীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কথা হয় লাশ উদ্ধারকারী ডোম জাগু মিয়ার সঙ্গে। তিনি তার অভিজ্ঞতার বর্ণণা দিয়ে বলেন, অন্য জায়গা থেইক্যা মাইরা আইনা লাশ রূপগঞ্জে
ফেলায়। রূপগঞ্জের অনেক এলাকা নীরব থাহে। এই সুযোগ কাজে লাগায়। প্রত্যেক মাসেই লাশ পাওয়া যায়। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহমুদুল হাসান বলেন,
রূপগঞ্জের অনেক এলাকা অনেক নীরব। আর এ সুযোগ নিয়ে লাশ ফেলে যায় দুষ্কৃতিকারীরা। লোকবল সঙ্কটে সব জায়গায় পাহাড়া দেয়া সম্ভব না হলেও পুলিশি টহল অব্যাহত রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিজান চলছে।
তবে গুরুত্বপূর্ন স্পটগুলোতে পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম বলেন, রূপগঞ্জ এলাকাটা ভাল। বাহির থেকে অপরাধীরা ঘটনা ঘটিয়ে রূপগঞ্জে ফেলে যায়।