তাল ও তাল গাছের বহুগুণ রয়েছে।কাঁচা তাল বা আসাড়ী গরমে প্রশান্তি আনে।সুস্বাধুও বটে।পাকা তালের মধুর রসে বুড়ো শিশুরা রাঙিয়ে নেয় মুখ।পাকা তালের বিভিন্ন মজাদার পিঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য।তালের কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মজবুত ঘর।আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে ক্রমবর্ধমান মানুষের আবাসন চাহিদা পুরনের জন্য বনভুমির গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলছে।তাল গাছও ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
ঐ দেখা যায় তাল গাছ,ঐ আমাদের গাঁ,ঐখানেতে বাস করে কানি বোগার ছাঁ।অথবা তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে-সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে এসব শিশুতোষ কবিতার মাঝে কবি সাহিত্যিকের চোখে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতিক তাল গাছ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে।তাল গাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথেই।
বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে,খালের পাড়ে ও রাস্তার পাড়ে তাল গাছ বাংলাদেশের প্রকৃতিকে করেছে বিশ্ব নন্দিত।কবি সাহিত্যিকগণ বাংলার প্রকৃতিকে নিয়ে লিখেছেন চিত্তাকর্ষক সব রচনা।এসব সৌন্দর্যের পেছনে রয়েছে আকর্ষণীয় সব প্রজাতির সমারোহ।এর মধ্যে বাঙালির অতি প্রয়োজনীয় একটি গাছ হলো তাল গাছ।যেটিকে অন্য সব গাছ থেকে আলাদাভাবে দেখা যায়,চেনা যায়। সেজন্যে কবি লিখেছেন : তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে।এখন গ্রাম-গঞ্জে,শহরে-বন্দর থেকে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে তাল গাছ।
পরিবেশ ও প্রকৃতি শুধু বন্ধুই নয়।মানুষের কল্যাণে এর জুড়ি নেই।তাল গাছ নিয়ে রচিত হয়েছে বহু কবিতা-গান।সুমিষ্ট ফল দেয়া ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে মানুষকে।বর্তমান সরকার তাল গাছ রোপণের উপর জোর দিলেও এক শ্রেণির মানুষ কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে।নানা কারণ দেখিয়ে রাস্তার পাশের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন তাল গাছ কেটে বিভিন্ন করাতকলে বিক্রি করছে।
গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়,বিগত প্রায় দেড় যুগ থেকে তাল গাছ নিধনযজ্ঞ শুরু হয় এখানে।এ ছাড়া তাল গাছের একটি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে ইটভাটার চুলায়।এলাকার প্রবীণরা বলেছেন গ্রামীণ জনপদে যেসব তাল গাছ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু গাছ লাগানো হলেও মূলত বেশির ভাগ তালগাছ বেড়ে উঠে প্রাকৃতিকভাবে অযত্নে অবহেলায়।আর এসব গাছ থেকে যুগে যুগে মানুষ ভোগ করেছে সুস্বাদু ফল ও রস।
প্রবীণ ব্যক্তি কালিপ্রদ রায় বলেন,গ্রামের প্রায় প্রতিটি রাস্তার কিনারায় ও পুকুর দিঘি পাড়ে দেড় যুগ আগেও দেখা যেতো সারি সারি তাল গাছ।বছরের এই মৌসুমে গাছে গাছে ভরা থাকতো তাল।অধিকাংশ গাছের পাকা তাল ঝড়ে পড়ে।গ্রামের মানুষ কুড়িয়ে পাওয়া তালের রস দিয়ে তৈরী করে সুস্বাদু পিঠা।তার মতে,এখন নব্বই শতাংশ তাল গাছ আগেই কাটা হয়ে গেছে।
রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের আউয়াল মিয়া বলেন,রূপগঞ্জের বাইর থেকে আসা বেপারীরা প্রতি গাছ ৪/৫ হাজার টাকায় কিনে নেয়।ওসব তাল তারা ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়।জানা যায়,ওদের তাল গাছের খুঁটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।রূপগঞ্জ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা,রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি লায়ন মীর আব্দুল আলিম বলেন গ্রাম থেকে নির্বিচারে তাল গাছ কেটে নেয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক।তিনি এলাকাবাসীর প্রতি তাল,নারিকেল,খেজুর গাছ না কেটে আরো বেশি করে এসব গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে,বন ও পরিবেশ রক্ষা ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার তাল গাছ রোপণ করছেন।অপরদিকে বিভিন্ন এলাকায় তালগাছ কাটছেন করাতকলের মালিক ও কাঠ ব্যবসায়ীরা।অনেকেই বিক্রি করছেন বিভিন্ন ইট ভাটায়।বিশেষজ্ঞদের মতে,তাল ও নারিকেল গাছ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা ও শোভাবর্ধনেও তাল ও নারিকেল গাছের জুড়ি মেলা ভার।একটা সময় বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কের পাশে সারি-সারি তাল গাছ শোভা পেতে দেখা গেছে।
আমাদের দেশের গ্রাম-বাংলার অতি প্রয়োজনীয় গাছ হিসেবে পরিচিত তাল গাছ।তাল গাছে তাল হয়,আসাড়ী হয়,তাল থেকে অনেক সুস্বাদু খাবার পায়েশ পিঠা হয়,তালের লম্বা জট পুড়ে দাঁতের মাজন হয়,তাল পাতার পাখা হয়,ঘরের ছাউনি হয়,তাল গাছে বাবুই পাখি বাসা বানায়,সবুজের সমারোহ ছড়ায়,তালের রসে বলকারক ঔষধ হয়,তালের রসে তাড়ি হয়,তাল গাছে কোন্দা (নৌকা) হয়।
তালের কাঠ খুবই মজবুত বিধায় ঘরের খুঁটি কিংবা আড়া খুব ভালো হয়।তালগাছ ফসলের ক্ষতি করে না।তাল গাছ দীর্ঘজীবী, মজবুত ও লম্বা হয়,আরো কত কি? এত গুণাগুণের গাছ বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়।ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তালের বিচি রোপণ করতে হয়।প্রবাদ আছে বারো বছরে ফলে তাল…….যদি না লাগে গরুর পাল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলার পূর্বগ্রামের শাহজালাল জানান,পাকিস্তান আমল থেকেই এসব এলাকায় তাল গাছের কদর ছিলো বেশি।আমরা আমাদের এলাকায় তালের কোন্দা (নৌকা) বানাতাম।এখন আগের মতো বড় বড় তালগাছ পাওয়া যায় না।বর্তমানে মানুষজন তালগাছ কেটে ফেলে।কিন্তু নতুন করে কেউ আর রোপণ করে না।
আমার অনেক তালগাছ ছিলো।নিজ প্রয়োজনে বাড়ি-ঘর করতে গিয়ে অনেক গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে।তার মতে,প্রকৃতি থেকে একটি প্রয়োজনীয় গাছ হারিয়ে যাবে এটা মেনে নেয়া যায় না।আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাল গাছের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত করলে এবং সরকারি ভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য তাল গাছ হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।এখনও দুই একটা তাল গাছ গ্রাম-গঞ্জের ঝোপ-ঝাড়ে দেখা গেলেও তা রক্ষায় নেই তেমন কোনো উদ্যোগ।
অতীতে অপরিচিত মানুষের বাড়ি,জমি,পুকুর,মাঠ,মসজিদ,মাদরাসা,স্কুল,কলেজসহ বিভিন্ন স্থান দেখানোর জন্য বলা হতো উচুঁ ওই তাল গাছটার পাশে।তালের পিঠা,তালের গুড়,তালের রস,সব মানুষের খুব মজাদার খাবার।বিশেষ করে অতীত সময় গুলোতে গ্রাম-বাংলায় তালের পিঠা ছাড়া আত্মীয়তা কল্পনাই করা যেত না।এছাড়া তাল গাছের পাতা দিয়ে তৈরি হয় নানা রকমের হাত পাখাও।ক্রমশই তাল গাছ হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে নেই সেই তালের পিঠার অস্তিত্ব।
রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ ফাতেহা নুর বলেন-যেভাবে তাল গাছ কাটা হচ্ছে,সেভাবে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না।রূপগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাল ও নারিকেল গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করাতকলে।সেখানে দে-দারছে ফাড়াই করা হচ্ছে তাল ও নারিকেল গাছ।আসবাবপত্রের উপকরণ তৈরি করছেন ও ইটভাটায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।তবে এ বছর সরকারি উদ্যোগে কিছু তাল বীজ রোপণ করা হবে বলেও আশা করছেন এ কর্মকর্তা।