সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের সুদিন ফিরে এসেছে নওগাঁয়। একসময় এ সোনালী আঁশ কৃষকের গলার ‘ফাঁস’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন অনেক কৃষকই পাট চাষ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গত কয়েক বছর থেকে পাটের দাম ভালো পাওযায় আবার চাষ শুরু করেছেন চাষিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পাট উন্নয়ন অফিস নওগাঁ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি। সেই জায়গায় চাষ হয়েছে ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ এ পাট চাষে কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে চাষ হয়েছে। আবাদকৃত জমি থেকে সর্বমোট ৭৭ হাজার ৩শ ৬৫ বেল পাট উৎপাদিত হবে বলে কৃষি বিভাগ প্রত্যাশা করছে।
কম জমিতে চাল হলেও বাজারে দাম বেশী হওয়ার কারণে কৃষক তার পাটের দাম পাচ্ছে। এদিকে, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও পাট বীজ উৎপাদন এবং পাট সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নওগাঁ জেলায় ৪টি উপজেলায় ১০, ১৮০জন পাট চাষি কৃষকে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও বীজ উৎপাদনর জন্য পাটের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে এবং চারশত পাট চাষিদের প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর দেশী, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট চাষ করেছেন কৃষকরা। দেশী জাতের মধ্যে ”সিভিএল- ১” , ”ও ডি ১৫৪” জাতের, তোষা জাতের মধ্যে ”ও ৯৮৯৭”, ”ও ৪”, ”চাকা”, ”বঙ্গবীর”, ”ও ৭২” এবং মেস্তা জাতের মধ্যে মেস্তা জাতের পাট উল্লেখযোগ্য।
সূত্র আরও জানায়, জেলায় দেশী জাতের ৫শ হেক্টর, তোষা জাতের ৫ হাজার ৯শ ৫০ হেক্টর এবং মেস্তা জাতের ৪শ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। উপজেলা ভিত্তিক পাট চাষের পরিমাণ, সদর উপজেলায় ৯শত ১০ হেক্টর, রানীনগর ৩৫ হেক্টর, আত্রাই ২৩৫ হেক্টর, বদলগাছি ১ হাজার ৮শ ১৫ হেক্টর, মহাদেবপুর ১শত ১৫ হেক্টর, পত্নীতলা ২৩ হেক্টর, ধামইরহাট ১ হাজার ৫শ ২০ হেক্টর, মান্দা ১ হাজার ৯শ ৯০ হেক্টর। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় কোন পাট চাষ হয় নি। সূত্র জানায়, পাট বিষয়ে গবেষণা, পাটের উৎপাদন, বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার ও রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে পাট সংশ্লিষ্ট খাকগুলো।
এছাড়া পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধিতে কাজ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ ও এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করেছে মন্ত্রণালয়। এর ফলে ধান, চাল, গম, সার ও চিনিসহ ১৯টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ায় দেশের বাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও পাট বীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারন প্রকল্পের আওতায় নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলা মধ্য চারটি উপজেলায় এ প্রকল্প চালু আছে, চারটি উপজেলা হলো, নওগাঁ সদর, মান্দা, বদলগাছী ও ধামইরহাট। এ চার উপজেলা ১০, ১৮০জন পাট চাষিদের প্রতিজন কৃষককে ১২ কেজি সার (৩কেজি টিএসপি, ৩কেজি পটাশ, ৬কেজি ইউরিয়া) এবং এক কেজি করে পাটের বীজ প্রতি এক বিঘা জমির জন্য দেওয়া হয়েছে। পাট চাষি সংখ্যা সদর উপজেলায় ২হাজার ৬শত জন, মান্দা ২হাজার ৬শত ১০জন, বদলগাছী ২ হাজার ৫শত ৭০জন এবং ধামইরহাট উপজেলায় ২ হাজার ৪শত জনকে পাট চাষের জন্য বীজ, সার ও প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে।
ধামইরহাট উপজেলার কৃষক সালাউদ্দীন শেখ বলেন, ‘এবার ২বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। গত বছর ১ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। গত বছর পাটের দাম ভালো পাওয়ায়। সেই আগ্রহ থেকেই এবারও তিনি পাট আবাদ করেছেন।’ তিনি আরোও বলেন, ‘গত তিন বছর থেকে পাটের ভালো দাম পাচ্ছি। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ধান ও পাটের আবাদে বর্তমানে লাভ বেশি হচ্ছে। পাট চাষের প্রশিক্ষণে স্যারেরা আমাদের বলেছেন, এই পাট দিয়ে ২০০ এর অধিক পণ্য তৈরি হয়। যে পণ্যগুলো বিদেশে যায়। তাছাড়া সরকার পাটের তৈরি বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামুলক করায় পাটের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণেও আমরা চাষিরা পাটের ভালো দাম পাচ্ছি।’ মান্দা উপজেলা মৈনুম গ্রামের কৃষক কাজী আব্দুস ছালাম বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও পাটের দাম ভালো না পাওয়ায় অনেক চাষি পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল।
গত দুই/তিন বছর ধরে পাটের দাম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতবছর ভালো দাম পেয়েছি। ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি করেছিলাম। দাম ভালো পাওয়ার কারণে এবং লাভবান হওয়ায় এ বছর চার বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি।’ নওগাঁ পাট অধিদপ্তরের উন্নয়ন কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও পাট বীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারন প্রকল্পের আওতায় নওগাঁ জেলার চারটি উপজেলায় এ প্রকল্প চালু আছে। এ প্রকল্পের আওতায় এ জেলায় দশ হাজার পাট চাষিদের সার ও পাট বীজ দিয়ে এবং চারশত জন কৃষককে প্রশিক্ষন দিয়ে পাটের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, পাটের রোগবালাই তেমন একটা নেই। পাটও বেশ ভালো হয়েছে। গত বছরে মত এ বছরও পাটের দাম কৃষক ভালো পাবে বলে আশা করছি।
দেশে ও বিদেশে আমাদের পাটের চাহিদা বাড়ছে। সে কারণে কৃষক দাম ভালো পাচ্ছে। এভাবে দাম থাকলে আগামীতে আরও বেশি জমিতে পাটের চাষ হবে।’ নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল ওয়াদুদ যায়যায়দিনকে বলেন, পাট থেকে শুধু ছালা, বস্তা ও চট এগুলোই তৈরি হয় না। পাট থেকে ১৩১ ধরনের পাটপণ্য উৎপাদন করছে এবং বিদেশে এই পণ্যগুলোর খুরই চাহিদা। এ ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ মার্কেটেও এই চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছ। তিনি বলেন, আমরা পাট চাষিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। পাটের সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে। পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এতে আমাদের পরিবেশ রক্ষা পারে, পাশাপাশি পাটের হারানো ঐতিহ্য, গৌরব ফিরে আসবে। কৃষক পাট চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এবং পাটের ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছে। গত বছর কৃষক এক মণ পাট বিক্রি করেছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০টাকা পেয়েছে। ক্রমেই আমরা এভাবে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।