প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত সুনামগঞ্জের পর্যটন এলাকার অধিকাংশ রাস্তাই চলাচলের অনুপযোগী।প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন এই এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে।কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন তারা।কারণ সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ সংযোগের সীমান্ত রাস্তা দিয়েই যেতে হয় তাদের গন্তব্যে।
এই সড়কটির বারেকটিলা থেকে মহেষখোলা পর্যন্ত আনুমানিক ১০কি.মি. রাস্তার খুবই বেহাল দশা।প্রায় তিন দশক পূর্বে তৎকালীন সংস্থাপন সচিব ড. শাহ মোহাম্মদ ফরিদের প্রচেষ্টায় জাদুকাটা নদীর খেয়াঘাট থেকে বারেকটিলার ওপর দিয়ে চলাচলের জন্য ১ কিলোমিটার সরু পাকা সড়কটি নির্মাণ হয়েছিল।কিন্তু বছরের পর বছর সড়কটি সংস্কার না করায় এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
১ কিলোমিটার দৈর্ঘের এ সড়কটিতে বর্তমানে গর্তের সংখ্যা হাজারেরও বেশি।পাকা রাস্তার অস্তিত্ব বর্তমানে নেই বললেই চলে।প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান হতে সুনামগঞ্জ হয়ে তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী,বারেকটিলা,জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান,রাজাই ঝর্ণাধারা,টেকেরঘাট শহীদ সিরাজ লেক,লাকমাছড়া,লালঘাট ঝর্ণাধারা,টেকেরঘাট স্কুল ঝরণা ধারাসহ মাদার হেরিটেজ প্রকল্প টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখতে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কিন্তু খরস্রোতা যাদুকাটা নদীর ব্রীজের কাজ এখনও সম্পন্ন না হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা জাদুকাটার খেয়াতরী পাড়ি দিয়ে বারেকটিলায় প্রবেশ করেন।তারপর বারেকটিলার নীচে অপেক্ষারত ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল,অটোরিকশা নিয়ে তারা সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন।
অপরদিকে রাজস্বখাতেও তাহিরপুর উপজেলাটির অনেক অবদান রয়েছে।উপজেলাটির ১নং শ্রীপুর(উত্তর) ইউনিয়নে রয়েছে তিনটি স্থল বন্দর।যে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে হাজার হাজার মে.টন কয়লা ও চুনাপাথর।এই স্থলবন্দরগুলো থেকে সরকার প্রতি বছর কয়েকশো কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকেন।
কিন্তু রাস্তাঘাট না থাকার কারনে এ সমস্ত আমদানীকৃত কয়লা-চুনাপাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে পরিবহনখাতেও কয়েকগুন বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।এ উপজেলার লালঘাট থেকে শুরু করে বীরেন্দ্র নগর স্থল বন্দর পর্যন্ত রাস্তাটি যেনো এলাকাবাসীসহ ময়মনসিংহ,নেত্রকোনা,ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের জন্য অভিশাপ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও এখনো পর্যন্ত চলাচলের অনুপযোগী রয়ে গেছে তাহিরপুর সদর থেকে সুলেমানপুর সড়ক,তাহিরপুর-বাদাঘাট সড়ক,বারেকটিলা থেকে মহেষখোলা সড়কসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা।আর এ রাস্তাগুলোই এখন এই এলাকার মানুষের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।চলাচলে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।
বর্ষা মৌসুমে রাস্তাগুলো পানি-কাদায় একাকার হয়ে যায়।বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে চলাচল করতে হয় সীমান্ত জনপদে বসবাসরত লাকজনের।জুতা হাতে জল-কাদা মাখা শরীরে চলেন শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার লোকজন।শুধু তাই নয় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী,ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের।এই রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের চলাচল।
সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় মানুষের অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তা কাদায় ভরে যায়,কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না।এমনকি পিচ্ছিল হওয়ার কারনে হেঁটেও চলাচল করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে।
গ্রামে কোন লোক অসুস্থ হলে তাকে দুইজন লোকে ভারে(বাশের তৈরি খাটিয়া জাতীয়) বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।কারণ অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।এমন কি গ্রামে কেউ যদি মারা যায় তার দাফনের কাজ সম্পন্ন করতে বেশ কষ্ট ভোগ করতে হয়।আবার শুকনো মৌসুমেও রাস্তার ধুলোর কারণে কাশিসহ অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার শালিয়া গ্রাম থেকে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভ্রমনে আসা আজাদ শেখ জানান,বারেকটিলার ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল বা অটোরিকশা নিয়ে চলাচলে বড় ঝুঁকি রয়েছে।কারণ টিলার উপর দিয়ে একে-বেকে চলা সরু সড়কটিতে গর্তের সংখ্যা হাজারেরও বেশি,আবার সড়কটির একাধিক স্থানে সিমেন্টের ঢালাই খসে গিয়ে অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পর্যটকরা এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছে।অপরদিকে খরচও অনেক বেশি,মাত্র ৫ কিলোমিটার জায়গার যাতায়াত খরচের জন্য গুনতে হয় হাজার টাকা।সীমান্ত এলাকার রাজাই এলাকার বাসিন্দা আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক এন্ড্রো সলোমার জানান,প্রতিনিয়তই এ সড়কে দূর্ঘটনার স্বাীকার হচ্ছে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা কিংবা এতে মারাত্মক আহত হয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
তিনি বলেন,দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সড়কটির এ অবস্থা।কিন্তু বিষয়টি সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নজরে পড়ছে না।তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি হাজি আলকাছ উদ্দিন খন্দকার বলেন,বড়ছড়া, চারাগাঁও বাগলী এ তিন শুল্ক স্টেশনে সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা,ময়মনসিংহ সীমান্ত সড়ক হয়ে হাজারো ব্যবসায়ী,শ্রমিক,সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন।
কিন্তু এই সীমান্ত সড়কটির লালঘাট থেকে বীরেন্দ্র নগর পর্যন্ত অংশটি চলাচলের অনুপযোগী।সড়কটি সংস্কারে সওজ কিংবা এলজিইডির দায়িত্বশীলদের বারবার অনুরোধ করেও কাজ হয়নি।মহেষখোলা থেকে বারেকটিলা পর্যন্ত রাস্তাটির সংস্কারে তারা কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সুনামগঞ্জ ২৮ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল তসলিম এহসান দৈনিক কালজয়ীকে জানান, বারেকটিলার পশ্চিমে চাঁনপুরসহ মাটিরাবন অবধি ৭টি বিওপিতে থাকা বিজিবি সদস্যরা সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করেন।টিলার এ জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দ্রুত প্রশস্ত করলে এর সুফল পাবে সর্বস্তরের মানুষ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন দৈনিক কালজয়ীকে বলেন,বারেকটিলা থেকে মহেষখোলা সড়কটি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশস্ত ও পুনঃনির্মানে সওজ এবং এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।