আগেকার দিনে অবস্থা সম্পন্ন প্রায় প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে একজন করে লজিং মাস্টার থাকতো। ১৯৭০-৮০ ‘র দশকের দিকে এ প্রথার বহুল প্রচলন ছিল আমাদের এদেশে। লজিং প্রথা শুরুর সঠিক দিনক্ষণ জানা না থাকলেও এদেশে বৃটিশ আমল থেকেই লজিং প্রথা চালু হয় বলে জানা যায়।
প্রাচীনকালে শিক্ষাগুরুর বাড়িতে শিষ্যরা জ্ঞান আহরণ করতে যেত। সেখানে শিষ্যরা নিজেদের ভরণপোষণ নিজেরাই বহন করতো। যাওয়ার সময় চাল, ডাল সহ অন্যান্য খাদ্য শস্য ছাড়াও দামী পণ্য সামগ্রী নিয়ে গুরুর বাড়িতে অবস্থান করতো।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুকেই বহন করতে হতো শিষ্যের সকল ভরণপোষণ। শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি শিষ্যরা গুরুর বাড়িতে বিভিন্ন কাজকর্ম করতো। তখনকার শিক্ষাগুরুদের মানইজ্জত ছিল আকাশচুম্বী ও রাজকীয়। তখনকার রাজা-বাদশারাও শিক্ষকদের খুব সম্মান করতেন। মোগল আমলে রাজা-বাদশার সন্তানরাও শিক্ষকের বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো।
এরপর দিল্লী সম্রাটের আমলে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়। আস্তে আস্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন থেকেই দূর দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসে। অনেক দূরের পথ হওয়ায় এবং ছাত্রাবাস গড়ে না উঠায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী ধনী গৃহস্থের বাড়িতে লজিং থাকতো। লজিং বাড়িতে থাকা ও খাওয়ার সুবিধার বিপরীতে তারা গৃহস্থবাড়ির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাত। বিনিময়ে লজিং মাস্টাররা তিনবেলা নাশতা সহ খাওয়া ও থাকার সুযোগ পেত।
লজিং মাষ্টারদের গৃহস্থের বাড়িতে গৃহস্থের সাথে একঘরে থাকার সুযোগ ছিল না। বাড়ির বাইরের আঙিনায় নির্মিত বাংলা ঘর বা কাছারিঘরে লজিং মাস্টারকে থাকতে দিত। গৃহস্থের ছেলেমেয়েরা সকাল বিকাল বাংলা, আরবী, ইংরেজি সহ অন্যান্য বিষয়ে লজিং মাস্টারের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতো। এভাবেই লজিং মাস্টারের জোর প্রচলন শুরু হয়।
আজ থেকে ১০/১৫ বছর পূর্বেও বিভিন্ন বাড়িতে লজিং মাস্টারের দেখা মিলত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্ররা লজিং থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন চাকরীতে যোগদান করা ব্যাক্তিও এই সুযোগ গ্রহণ করতো। তা না হলে চাকরীস্থল থেকে প্রতিদিন বাড়ি এসে তাদের পক্ষে চাকরী করা সম্ভব ছিল না। বিশাল দূরত্ব ও যাতায়াতের অসুবিধা এবং অভাবের তাড়নায় এক রকম বাধ্য হয়ে অনেকেই লজিং থাকতো।
লজিং মাষ্টার নিয়ে পরবর্তীতে অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনার অবতারণা হয়। প্রথম দিকে একজন লজিং মাস্টারের অনেক সুনাম ও আত্মমর্যাদা থাকলেও দিনকে দিন তা হ্রাস পেতে থাকে। ধীরে ধীরে লজিং মাস্টারকে দেয়া খাবারের মান খারাপ হতে শুরু করে। তবুও লজিংয়ে থেকে বাধ্য হয়ে এসব কিছু নীরবে সহ্য করতে হতো একজন লজিং মাস্টারকে। বহু লজিং মাস্টার নিজ ছাত্রী ছাড়াও গৃহস্থের বউয়ের সাথে প্রেম বাঁধিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে লজিং মাস্টারকে দেখা গেছে, নিজ লজিংয়ের ছাত্রীকে বিয়ে করে স্বপ্নের বাসর গড়তে। অনেকে আবার ছাত্রী নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে লজিং মাস্টার প্রথার গায়ে চুনকালি মেখেছে। এভাবে বহু গৃহস্থের চোখের ঘুম ও মনের আরাম হারাম করেছে লজিং মাষ্টাররা। এখনো অনেকের সাথে গল্প করলে বা আলাপচারিতায় ডুবে গেলে, লজিং ছাত্রীকে বিয়ের করার সত্য ঘটনা জানতে পারা যায়।
কিভাবে কত নদী, কত সাগর পাড়ি দিয়ে; কত আন্দোলন সংগ্রাম করে লজিং ছাত্রীকে বিয়ে করেছে, তার জলজ্যান্ত কাহিনী শোনা যায়। এসব অসঙ্গতি এবং গৃহস্থ বাড়ির মানসম্মান ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় এবং লজিং বাড়িতে লজিং মাস্টারের রাজকীয় কদর কমে যাওয়ায় এ প্রথা এখন প্রায় বিলুপ্ত। এখন আর কোথাও কাউকে লজিং থাকতে দেখা যায় না।
এছাড়া এখন প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা এখন ঘরে বসে আরাম আয়েশে থেকে খুব সহজে লেখাপড়া শিখতে পারছে। তাছাড়া লজিং যাওয়াকে অনেকেই এখন মানহানিকর মনে করে। এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খুব সহজে প্রাইভেট বা কোচিং পড়তে পারছে। একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীও প্রাইভেট বা কোচিং পড়িয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করতে পারছে।
খুব সহজে মেটাচ্ছে তার প্রয়োজনীয় চাহিদা। তাই লজিং মাস্টারের প্রসঙ্গ সবার কাছেই এখন অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। লজিং মাস্টারের প্রথার মত এরকম আরো বহু প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময় বিলুপ্ত হবে বর্তমানে প্রচলিত আরো অনেক প্রথা। এবং এটাই সত্য।
এক সময় স্বশরীরে গিয়ে চাকরী বা অফিস করার প্রয়োজন হবে না। হয়ত আর কয়েকবছর পরই এসব কাজ করে দেবে রোবট। মানুষ হয়ে যাবে কর্মহীন অলস। বহু মানুষ বেকার হয়ে যাবে। উদ্ভাবিত হবে আরো নতুন ও অভাবনীয় ব্যতীক্রমী জীবন ব্যবস্থা। কালের প্রবাহে পুরনো অনেক কিছু হারিয়ে গিয়ে উদ্ভব হবে নতুন ও চমকপ্রদ প্রথা বা জীবনব্যবস্থার।