বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা ভবনে কাজ করছিল শত শত শ্রমিক।পরিবারের ভরণপোষণ কাঁধে নিয়ে একবুক স্বপ্নের ডানামেলা উচ্চাশা নিয়ে ওরা কাজ করছিল বেশ মনযোগ দিয়ে।কারো দিকে তাকানোর সময় নেই তখন।মালিকের কঠোর চাহিদা মাফিক কাজগুলো শেষ করায় তাদের সবার বেশ তাড়া ছিল।
ওই সময় কেউ জানতো না এখানে আগুন লাগবে,জ্বলেপুড়ে ছাই হবে ঘামে ভেজা,দুঃখ সহা প্রিয় শ্রমিকদের সোনার দেহ,হীরক স্বপ্ন।যা তারা ভাবতে পারেনি কভু,তাই ঘটল সেদিন।হঠাৎ করে আগুনের লেলিহান শিখায় আর মেঘকালো ধোঁয়ায় চেয়ে গেল পুরো কারখানা ভবন।প্রধান লোহার গেইল বন্ধ,ফ্লোরের গেইট বন্ধ,তালাবদ্ধ ছিল ছাদে যাওয়ার দরজাও।
আগুন থেকে বাঁচতে বহু চেষ্টা করেও কেউ বাঁচতে পারছিল না।বিভিন্ন ফ্লোরে তালাবদ্ধ রুমে আটকা পড়ে শ্রমিকরা।বহুসংখ্যক শ্রমিক সিঁড়িপথে তালাবদ্ধ গেইটে এবং ছাদের বন্ধ দরজায় বারবার এসে নিজেদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল।কিন্তু পারে নি।মালিকপক্ষের কেউ যদি ওই সময় গেইটগুলো খুলে দিত,এত শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটত না।
বহু শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিদের আগুন লাগার ঘটনা জানিয়ে গেইট খোলে দেয়ার অশ্রুসজল আকুতি জানিয়ে ফোন করেছে।তখন মালিক পক্ষের লোকজন গেইট খুলে না দিয়ে বলল,এটা সামান্য আগুন,এ আগুনে কিছুই হবে না।আগুন নিভিয়ে ফেলা হচ্ছে।যখন তারা বুঝতে পারল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন আর চেষ্টা করেও নিজেরা গেইট খুলতে পারল না।
তাই শ্রমিকরা যে যেখানে ছিল,সেখানেই পুড়ে মারা গেল।ভবনটির চতুর্থ তলার তালাবদ্ধ এসি রুমে আটকা পড়ে ৪৯ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়! মারা যাওয়ার শেষ মুহুর্তে শ্রমিকরা নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে ক্ষমা চেয়ে,নিজ সন্তানদের দেখে রাখার কথা বলে শেষ বিদায় নেয়।আহা! কি মর্মান্তিক বিষয়।হৃদয় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অতি করুণ দুঃখজনক ঘটনা!
প্রাণ হারায় ৫২ জন শ্রমিক।আহত হয় আরো ২৫ জন।নিখোঁজ আছে আরো অনেকে।নারায়ণগঞ্জের বাতাসের লাশ পোড়া উদ্ভট গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।যেদিকে ফিরেই নিঃশ্বাস নিই,শ্রমিকদের পোড়া গন্ধ খুজে পাই আমরা।ভয়ানক করোনার অতিসংখ্যক লাশের সারির সাথে পুড়ে অঙ্গার হওয়া আরো বায়ান্নটি লাশ যোগ দিল।
প্রিয় স্বদেশ পরিণত হলো শ্মশানপুরীতে।লাশ,এ্যাম্বুল্যান্সের করুণ আর্তনাদ,স্বজনের কলিজা ভাঙা বুক ভাসানো বিলাপ শুনি চারপাশে।নীরব নিথর হয়ে মাটির বুকে অভিমানী হয়ে শুয়ে যাওয়া লাশগুলো কোনো কথাই বলতে পারে না।তবু তারা অনেক কিছুই বলে গেল নীরবে।আমার মৃত্যুর জন্য ওরা দায়ী,আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম ওরা আমায় বাঁচতে দিল না,ওদের বিচার করো তোমরা,অন্ততঃ এতীম হওয়া আমার সন্তানগুলোকে দেখে রেখোসহ আরো অনেক অভিযোগ ওরা করে গেছে,করে যাচ্ছে আমাদের কাছে।
জানি না- ওদের পরম প্রত্যাশার কোন কোন দাবীগুলো আমরা মেটাতে পারব,আর কোনগুলো পারব না।সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত হাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা ভবন সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক জিল্লুর রহমান শনিবার সাংবাদিকদের বলেন,ভবনটিতে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না।পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট ছিল না।
ছিল না কোনো অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা।এছাড়া ভবনটিতে আরো অনেক ত্রুটি ছিল বলে তিনি দাবী করেন।যারা এই ভবনটির নকশা,নির্মাণ পরিকল্পনা সহ আগুনে ভস্মীভূত অবস্থা পর্যন্ত জড়িত ছিল তারা সবাই খুনী।তারা অগণিত অজস্র শ্রমিককে হত্যা করেছে।এটাকে পরিষ্কারভাবে ভয়ানক গণহত্যা বলা যায়।এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
আমরা মহামান্য আদালতের কাছে নিরীহ,অসহায়,আমাদের সভ্যতার মহান কারিগর-এসব শ্রমিকদের ন্যায় বিচারের আকুত আর্তি জানাচ্ছি।আদালত তাদের ন্যূনতম শাস্তি মৃত্যদণ্ড দেবে,সে আশায় আমরা দেশবাসী আশাবাদী।শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান নিহত প্রতিটি শ্রমিক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লক্ষ এবং আহত শ্রমিকদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এ সামান্য টাকায় তাদের কি হবে? একটি জীবনের মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশী।আপনী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করব,টাকার অঙ্কটা পুনর্বিবেচনা করবেন।একটা পরিবারের মাথার ছায়া হারিয়ে গেলে,তারা কতটুকু অসহায় হয়ে পড়ে-এই কথাটি অন্ততঃ দয়া করে বিচার-বিবেচনা করুন।এরচেয়ে বেশি জরুরি অপরাধীদের কঠোর শাস্তি।
সেটা নিশ্চিতে কোনো ব্যঘাত ঘটলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে,শ্রমিকরা আর কারো উপরই আস্থা রাখতে পারবে না।পৃথিবী তোলপাড় করা এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবুল হাসেম সহ পুলিশের করা মামলায় অভিযুক্ত মোট আটজনকে চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
শনিবার বিকেলে পুলিশের করা দশদিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসামীদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামীদের মধ্যে রয়েছে,প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডি আবুল হাসেমের চার ছেলে-হাসিব বিন হাসেম,তারেক ইব্রাহিম,তাওসীব ইব্রাহিম ও তানজীম ইব্রাহিম।
এছাড়াও হাসেম ফুড লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ শাহ আজাদ,ডিজিএম মামুনুর রশীদ ও এডমিন প্রধান সালাউদ্দিন।ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংগঠন,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিবর্গের দাবী অনুযায়ী দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবী জানাচ্ছি।তার সাথে সাথে প্রতিটি নিহত ও আহত শ্রমিক পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত আর্জি রাখলাম।
লেখকঃ শিক্ষক,সাংবাদিক,সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী।