সকল প্রাণীর মাঝে প্রেম-ভালবাসা বিরাজমান থাকে।মানুষ যেমন মানুষকে ভালোবাসে তেমনি প্রাণীরাও প্রাণীদের ভালোবাসে।আবার কিছু কিছু ভালোবাসা হয় মানুষ ও প্রাণীর মাঝে।এতে মানুষ ভালোবাসে প্রাণীকে।আবার কোনো কোনো সময় প্রাণীও ভালোবাসে মানুষকে।প্রাণীদের প্রতি ঠিক এমনি একটি ভালোবাসা চোখে পড়ে ঠাকুরগাঁও রোড সুগারমিল কোলনি এলাকার মৃত হবিবর রহমানের স্ত্রী রেহেনা বেগম (৫৫)কে দেখে।
সোমবার সকালে ঐ এলাকার উত্তর হরি-হরপুর গ্রামে গেলে চোখে পড়ে এমনি একটি দৃশ্য।ফাঁকা একটি মাঠে ভেড়াগুলো খোঁলা আকাশের নিচে চরায় বেড়াচ্ছেন আনন্দের সাথে।কিন্তু অর্থের অভাবে সঠিক পরিচর্যা নিতে পারছেনা তিনি তার ভেড়াগুলোর।এরপরেই কাছে যাওয়া হলো রেহেনা বেগমের।এতো আনন্দের সাথে ভেড়া চরানো ব্যাপারটি জানতে চাইলে তিনি এক উত্তরে বলে উঠেন,‘আমি আমার সন্তানকে যে পরিমান ভালোবাসি এই ভেড়াগুলোকেও তেমনি ভালোবাসি।
বেড়ে উঠলো আগ্রহ তার প্রতি।এবারে শুনা গেলো তার জীবনের কিছু দু:খ ভারা কাহিনী।জানা যায়,দীর্ঘদিন আগেই মারা যায় রেহেনা বেগমের স্বামী হবিবর রহমান।জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামী বিক্রি করতেন কলা।মাঝে মাঝে চালাতেন রিকশা।এভাবেই কোন রকম ভাবে কেটে যেতো সংসার।এর পরে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুতে পরিবারের উপরে নেমে পড়ে আকাশের ভার।সন্তানদের নিয়ে যাবেন কোথায়।কি করবেন কি না করবেন।নেই থাকার কোন জায়গা।
অবশেষে এলাকাবাসীর সহযোগীতায় উত্তর হরি-হরপুর গ্রামে একটি জায়গায় তাকে দেওয়া হয় থাকতে।আস্তে আস্তে সকলের সাহায্য নিয়ে দিনের পর দিন কষ্টের মধ্যে কেটে যায় তার সংসার।এক পর্যায়ে বিয়ে দিলেন বড় ছেলে বাহাদুরের।তিন সন্তানদের মধ্যে কেউ কাজ করেন হোটেলে,কেউবা মানুষের ধার করা রিকশা চালায়,কেউবা বেকার।অভাবের সংসারে অবশেষে থাকলেন না কেউ।চলে গেলেন দুই ছেলেই।
বড় ছেলের বিয়ের পরেই রেহেনাকে তার ছেলে ডিমেন্ডের টাকা দিয়ে কিনে দেয় ২ টি ভেড়া।এর পরে আস্তে আস্তে এই ভেড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এক পর্যায়ে প্রায় ৩০ টির মতো ভেড়া হয় রেহেনার।অভাবের সংসারে কিভাবে ভেড়াগুলো দেখাশুনা করেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,যেখানে নিজেই পাইলে খাই,মানুষ দিলে খাই সেখানে আর কিভাবে ঠিক মতো এই ভেড়াগুলো দেখাশুনা করবো।বাসার সামনে মাঠ,সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মাঠে গরু ও ছাগলের ভিড়ে এলোমেলো ঘুরে ঘাস খায়ে বেড়ায়।সারা দিন এই মাঠ আর আশপাশের সড়কে ঘুরে ফিরেই ভেড়াগুলোর বেলা কেটে যায়।ভেড়াগুলো বাড়ি ফিরে সন্ধ্যাবেলা।এর পরে আর কি খেতে দিবো নিজেরি পেটে ভাত একবেলা জুটে তো আরেক বেলা নাই।এর পরেই হার না মেনে ভালোবাসার মর্যাদা রেখে অভাবের দিনের মধ্যেও তিনি অনেক আনন্দের সাথেই লালন পালন করে যাচ্ছেন ভেড়াগুলো।
স্থানীয় বাসিন্দা জাহানার জুই নামের একজন বলেন,অনেকদিন ধরেই দেখে আসছি এই রেহেনা বেগমকে।সারাদিন যার তার বাসায় কাজ করতেন তিনি।হঠাৎ করেই তার কাজের দিকটি একটু কমিয়ে যায়।খবর নিয়ে দেখি তিনি ভেড়া নিয়ে ব্যস্ত।কারন তিনি বাসা থেকে বেশিক্ষন বাহিরে থাকলে কুকুরে যদি তার ভেড়া খেয়ে ফেলে এই ভয়ে তিনি এখন একটু কম সময় অন্যের বাসায় কাজ করেন।
রেহেনা বেগম যেভাবে ভেড়াগুলো সাথে সময় দেয় তাতে স্পৃষ্ট তার প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসাটি দেখা যায়।আসলেই তিনি অনেক মহৎ।প্রাণীদের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে আমি সহ এলাকার সকলেই আমরা মুগ্ধ।তবে মহিলাটি অনেক কষ্টেই আছেন।শুনেছি তার বয়স্ক ভাতা/বিধবা ভাতা কিছ্ইু নেই।যদি এগুলো করে দেওয়া হয় তাহলে অনেকটাই ভালো হবে।
অবশেষে কথা হলো সেই প্রাণীর প্রতি এতো ভালোবাসা দেখানো ব্যক্তি রেহেনা বেগমের সাথে।তিনি বলেন,ভেড়া পালনে বলতে গেলে কষ্ট অনেক কম।তাদের কোনো বিমার (অসুখ) নাই।ভেড়া মূলত বছরে একটি স্ত্রী ভেড়া দুবার এক থেকে দুটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে।একটি ভেড়ি থেকে বছরে দুই থেকে চারটি বাচ্চা পেয়ে থাকি।সব থেকে বড় কথা ভেড়া পালনে বাড়তি কোনো শ্রম দিতে লাগে না।
তিনি আরো বলেন,মানুষের সাথে মানুষেই প্রতারণা করে এটা দুনিয়ার বাস্তবতা।কিন্তু প্রাণীরা এই প্রতারণা করেনা।এই ভেড়া পালন আমার কাছে অনেক সৌখিন।তবে কষ্ট লাগে এখানেই যখন সঠিক পরিচর্যার ফলে মারা যায় আমার এই আদরের ভেড়াগুলো।খুবি কষ্ট লাগে।যদি সঠিক পরিচর্যা নিতে পারতাম তাদের ভালো খাবার দিতে পাড়তাম তাহলে হয়তো এর আগে আমার যে ভেড়াগুলো মারা গেছে সেগুলো আর মরতো না।
ঠাকুরগাঁও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান,ভেড়া পালনের সুবিধা অনেক।তাদের জন্য বাড়তি কোনো খাবার লাগে না।একটু খেয়াল রাখলেই চলে।তেমন কোনো শ্রমও দিতে হয় না।তবে রেহেনা বেগমের যদি প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার কোন রকমের কোন সহযোগীতার প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা অবশ্যই সেটার চেষ্টা করবো।