কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সূর্যনগর গ্রাম।রাস্তার পাশে বিশাল বটবৃক্ষ।ডালপালার ছায়ার ঘেরা সুনসান নীরবতা।এমন পরিবেশে ওই গ্রামে একটি মাটির তৈরি স্কুল ভবন জানান দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও এ জনপদের অতীত ইতিহাসের কথা।রামধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।বাঁশের বেড়া ও ছন দিয়ে প্রথমে স্কুল ভবনটি নির্মাণ করা হয়।পরবর্তীতে মাটি ও টিন দিয়ে তৈরি হয়েছিলো স্কুল ভবন।তবে স্কুলটি সংস্কারহীন।তাই জরাজীর্ণ।পঞ্চাশ বছর পুরোনো মাটির ভবনটির সাথে মিশে আছে ওই এলাকার অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য।
রামধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি পাকা ভবনে এখন লেখাপড়া হয়।১৯৯৪ এবং ২০০৬ এ দালান দুটি তৈরি হয়।তার আগ পর্যন্ত স্কুল প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশে মাটি দিয়ে তৈরি করা স্কুল ভবনেই লেখাপড়া হতো।স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৯৭১ সালে রামধনপুর গ্রামের জন্য বিদ্যালয়টি বরাদ্দ করা হয়।তবে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাশের সূর্যনগর গ্রামে ১৯৭৩ সালে কাঁচা মাটি দিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়।তবে নাম থেকে যায় রামধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আইনজীবী একেএম ফজলুল হক।গত ৪ বছর আগে তিনি র্বাধক্যজনিত কারণে মারা যান।
চারদিকে এখন ইট পাথরের দালান কোঠা তৈরি হচ্ছে।কোথাও এখন মাটির ঘর খুব একটা দেখা যায় না।তবে এতসব আমূল পরিবর্তনের মাঝে দাড়িয়ে থাকা মাটির ভবনটি নিয়ে বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের আবেগের শেষ নেই।অনেকেই মাটির দেয়ালে হাতড়ে খুঁজে বেড়ান স্কুল জীবনের সব স্মৃতি।রামধনপুর সরকারি বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বয়স হয়েছে।এখন বাড়িতে অবসর আছেন।আবদুর রহমান জানান,প্রথমে স্কুল ভবনটি বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনি দেয়া ছিলো।
পরে মাটি ও টিন দিয়ে স্কুল তৈরি হয়।আবদুস সাত্তার জানান,স্বাধীনতার পরপরই স্কুলটি চালু হয়।আমরা তখন কেউ লুঙ্গি পরে কেউবা পায়জামা গেঞ্জি পরে স্কুলে আসতাম।মাস্টার মশাইরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে আসতো।শিক্ষকদের হাতে মাটির চক, ডাস্টার ছিলো।আমরা কাঠের সিলেটে লিখতাম।তখন টেবিল ছিলো না।মাটিতে পাটি বিছিয়ে চলতে আমাদের লেখাপড়া।সূর্যনগর গ্রামের সন্তান আবু মিয়া।স্কুলটির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
স্কুলটির পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিলো।স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যাওয়া আসা করতেন।স্বাধীনতার পরপরই স্কুলটি নির্মাণ করা হয়।এখন স্কুলের ইটের দালান হয়েছে।তবে এতদ্বঞ্চলে তখন স্কুল বলতে রামধনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো।এছাড়াও সবার ঘরবাড়িগুলো ছিলো মাটির তৈরি।গত ১০-১৫ আগে থেকে মাটির ঘরগুলো বিলুপ্ত হতে থাকে।দালান কোঠার বিপ্লব শুরু হয়।এখন এই অঞ্চলে এই মাটির স্কুল ভবন ছাড়া আর তেমন কোন মাটির ঘর চোখে পড়ে না।
করোনার কারণে স্কুল বন্ধ।তবুও নিয়ম মাফিক স্কুলে আসেন শিক্ষকরা।রামধনপুর স্কুলের সহকারী শিক্ষক কাজী মাঈন উদ্দিন জানান,স্কুলে রক্ষিত কাগজপত্র ঘেটে তিনি জেনেছেন ১৯৭১ সালে স্কুলটি নির্মিত হয়েছিলো।সে সময়কার মাটির তৈরি ভবনটি এখনো রয়ে গেছে।ঈদ বা অন্যান্য ছুটিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকে এসে তাদের প্রিয় স্কুলের মাটির দেয়ালে হাত রাখেন।স্মৃতির ঝাপি খুলে মাঠে বসে গল্প করেন।
এই মাটির ভবনে লেখাপড়া করেই অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত।দেশের ও দেশের মানুষের সেবা করছেন।যার মধ্যে মনিরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক।কুমিল্লা জজ কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ,পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনসহ আরো অনেকে।প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের দাবি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্কুলটি যেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে তাদের বাবা দাদারা কিভাবে কোন স্কুলে লেখাপড়া করেছে।এতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটা সুসর্ম্পক তৈরি হবে।
বিষয়টি নিয়ে রামধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি আবদুল হান্নান বলেন,আমরাও চাই মাটির ভবনটি সংরক্ষণ করা হোক।তাতে আমাদের ছেলে মেয়েরা জানবে আমাদের সময় কিভাবে মাটির ঘরে লেখাপড়া করতাম।মাটির ভবনটি সংরক্ষনে ইউএনও সদয় সম্মতি দিয়েছেন।
কুমিল্লা সদর দক্ষিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শুভাশিষ ঘোষ জানান,তিনি গত কয়েকদিন আগে স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে মাটির ভবনটি দেখতে পান।মাটির এই ঘরটিকে তিনি সংরক্ষণ করার চিন্তা করছেন।পাশাপাশি মাটির দালানটি সংস্কার করে একটি পাঠাগার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ঘর করা যায় কি না তা নিয়ে পরিকল্পনা করছেন।আর সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল হাসানের সাথে কথা বলেছেন।তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।