লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় মাদ্রাসা থেকে তবলিগ জামাতে গিয়ে রাব্বি নামের এক শিশু শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। তার পরিবারের দাবী তাকে অপহরণ করে গুম করা হয়েছে। অপরদিকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও তার সাথে তবলিগ জামাতে যাওয়া লোকজনের দাবী রাব্বি তিস্তা নদীতে গোসল করতে নেমে ডুবে গেছে।
শিশুটির পরিবার অপহরণ দাবী করলেও পুলিশ বলছেন অপহরণ নয় সে তিস্তা নদীতে গোসল করতে নেমে ডুবে গেছে। এদিকে গত ১৩ জুলাই আদিতমারীর মহিষখোচার তিস্তা নদীতে একটি অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয়দের দাবী ওটাই রাব্বির মরদেহ। তবে পরিবারকে খবর দিলেও তারা কোন কর্নপাত না করে মানববন্ধন নিয়ে ব্যস্ততা দেখান। রাব্বিতুল ইসলাম রাব্বি উপজেলার সিংগীমারী এলাকার আব্দুল রশীদের পুত্র। এছাড়া সে আলিমের ডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, গত ৬ জুলাই ওই মাদ্রাসা থেকে রাব্বিসহ প্রায় ১৮ জন উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের সোহাগের বাজার এলাকার একটি মসজিদে তিন দিনের জন্য তবলিগে যায়। এরপরের দিন ৭ জুলাই রাব্বি ওই মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী মসজিদের পাশেই খরস্রোতা তিস্তা নদীতে গোসল করতে নামে। গোসল করার এক পর্যায়ে রাব্বি স্রোতে ডুবে যায়। এ সময় তার সাথে গোসল করতে নামা শিক্ষার্থীরা চিৎকার করলে স্থানীয়রা ছুটে এসে নদীতে নেমে তাকে খোঁজা খুজি শুরু করে। তাকে খুজে পাওয়া না গেলে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে খবর দেয়া হয়।
তারা এসে অনেক চেষ্টা করেও রাব্বিকে খুজে পায়নি। রাব্বি তিস্তা নদীতে নিখোঁজ হয়েছে এমন খবর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে জানালে তা মানতে তারা নারাজ। রাব্বিকে গুম করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে দাবী করে হাতীবান্ধা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই শিশুর পানিতে ডুবে নিখোজ হওয়ার সত্যতা পায়। রাব্বির পরিবার তা মানতে নারাজ। আর তাই গত ১৭ জুলাই বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও আমলি আদালত-৪ লালমনিরহাটে একটি মামলা দায়ের করেন রাব্বির বাবা রশীদুল ইসলাম।
এদিকে গত ২১ জুলাই নিখোজ রাব্বিকে উদ্ধার ও তাকে অপহরণের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি করে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কে দাড়িয়ে মানববন্ধন করেন তার পরিবারের লোকজন। এর একদিন পর ২৩ জুলাই আবারও মানববন্ধন করেন রাব্বির পরিবারের লোকজন। পরিশেষে ২৭ জুলাই উপজেলা পরিষদ গেটের পাশে আমরণ অনেশন অবস্থান কর্মসূচিতে বসেন ওই শিক্ষার্থীর পরিবার।
সরেজমিনে উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের কিসামত নোহালী সোহাগের বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তাবলীগ জামাত যে মসজিদে গিয়েছিলেন তার পাশেই বয়ে গেছে খরস্রোতা তিস্তা নদী। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। যেখানে শিশু শিক্ষার্থী রাব্বি নিখোঁজ হয়েছেন সে স্থানেই নিমিষেই যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ডুবে যেতে পারে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন প্রত্যেক বছরই এখানে কেউ না কেউ পানিতে ডুবে মারা যান।
এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াছিন, ফেন্সি বেগম বলেন, কয়েকজন শিশু তিস্তা নদীতে গোসল করতে নামে। তার মধ্যে রাব্বি পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়। আমরা ও ডুবুরিরা অনেক খোঁজ খুঁজি করেও তার হদিস পাইনি।
রাব্বির পরিবারের দাবী রাব্বিকে গুম করে বিক্রি করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা নূর হোসেন সহ আরও অনেকে জানান, আমরা কেন মিথ্যা বলবো? রাব্বিও আমাদের কেউ না, যারা তাকে এনেছে তারাও আত্বীয় না যে মিথ্যা কথা বলবো। এখানে অনেকে দেখেছে সে গোসল করতে নামে। আর তাকে খুজতে শত শত মানুষ পানিতে নামে।
এ বিষয়ে উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের কিসামত নোহালী সোহাগের বাজার এলাকার আরাফাত উল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম মমিনুর রহমান বলেন, হাফেজ রাব্বিসহ ১৭ জন সাথী ভাই এই মসজিদে আসেন। ২য় দিন রাব্বিসহ কয়েকজন নদীতে গোসল করতে নামে। এরপর তাদেরই একজন চিৎকার করছে। রাব্বি ডুবে গেছে। আমরা সেখানে ছুটে যাই। আর স্থানীয় লোকজনসহ ডুবুরিদল অনেক খোঁজাখুজি করেও পাননা। এছাড়া তার পরিবার যে দাবী করছে তা অনৈতিক। তাকে কোন গুম করা হয়নি। এখানকার শত শত মানুষ তাকে খোজার জন্য নদীতে নামে।
ডুবে যাওয়ার পর রাব্বিকে খুজতে পানিতে নামা স্থানীয় যুবক ইউনূস বলেন, আমি পাশেই ছিলাম। চিৎকার শুনেই এগিয়ে যাই। যখন ওই শিশুর সাথে থাকা অপর শিক্ষার্থীরা বলে যে কেউ ডুবে গেছে, তখন আমি নিজেই নদীতে নেমে খুজতে থাকি। এরপর ডুবুরিদল আসে। তারাও অনেক চেষ্ট করে খুজে পায় না।
রাব্বির সাথে গোসল করতে নামা ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বলেন, রাব্বিসহ আমরা এক সাথে গোসল করতে নামি। এ সময় সে পানিতে ডুবে যায়। তখন আমরা চিৎকার করি। এরপর স্থানীয়রা এসে পানিতে নেমে তাকে অনেক খোঁজা খুঁজি করেও পায়নি।
এ বিষয়ে রাব্বির বাবা আব্দুর রশীদ বলেন, ওই মাদ্রাসার হুজুর আমাকে না বলে রাব্বিকে নিয়ে যায়। তারা আমার ছেলেকে গুম করেছে। সে পানিতে ডুবে যায়নি। তাকে অপহরন করা হয়েছে। ওই এলাকার শত শত মানুষ বলছেন রাব্বি ডুবে গেছে আর আপনি বলছেন তাকে গুম করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে রাব্বির বাবা কোন সদূত্তর দিতে পারেনি।
উপজেলার আলিমের ডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক রিয়াজুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম বলেন, রাব্বি নদীর পানিতে গোসল করতে নেমে ডুবে গেছে। আমরা অনেক খোঁজা খুজি করেও পাইনি৷ আমরা কেন তাকে গুম করবো। তাবলিগে আসার জন্য যা খরচ হয় তা তার পরিবার দিয়েছে। এখন তারা আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতেছে। আপনারা ওই এলাকায় গিয়ে খোজ নেন যদি কেউ বলে আমরা অপরাধী তাহলে সব দোষ মাথা পেতে নিবো।
হাতীবান্ধা থানার ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, রাব্বির পরিবার অপহরণ দাবী করলেও পুলিশ ঘটনাস্থল গিয়ে তদন্ত করে জানতে পারে রাব্বি পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন। সেখানে শত শত মানুষ ডুবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। এছাড়া এর কয়েকদিন পর আদিতমারীতে তিস্তা নদীতে একটি মরদেহ পায় পুলিশ। মরদেহ শনাক্তের জন্য রাব্বির পরিবারকে খবর দেয়া হলেও তারা কর্নপাত করেনি। তাই মরদেহ শনাক্তে ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে।