কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা গভীর শোক সাগরে নিমজ্জিত! অশ্রুর বাণে আর স্বজনদের বিরামহীন বিলাপে এখানের আকাশ, বাতাস আর চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। একজন সৎ, পরিচ্ছন্ন ও অতি মানবিক পুলিশ সুপারের অকাল বিদায়ে সারা এলাকায় শোকের মিছিল আর ব্যথাতুর অশ্রুর প্রবাহ বইছে বিরামহীন। যিনি চলে গেলেন সব মায়ার বাঁধন চিহ্ন করে, তিনি আর কেউ নয় রাঙামাটি ১নং এপিবিএনএ কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান হাবীব। মাত্র ৩২ বছর বয়সে গৌরবোজ্জ্বল জীবনের ইতি টেনে, সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষক মহান পিতা এবং বয়োবৃদ্ধ মাতার চোখে অশ্রুর বাণ। তাঁদের বুক গর্বে ভরিয়ে রাখা ছেলেটা আজ চলে গেল! সত্যি সত্যিই চলে গেল! আর ফিরবে না কোনোদিন। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে মাকে হাসাবে না আর। কথা বলবে না বীর গাঁথা গল্পে।
পরিবারের সবার ছোট হীরে মানিক ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান হাবীব। তাঁর প্রতি ছিল পরিবারের শ্রদ্ধাভাজন ভাই, বোন ও পাড়াপ্রতিবেশিদের গর্বিত আবদার। আজ পারেনি কাল রাখা যাবে সে আবদার। এই ভেবে কারো কারো পরম প্রিয় স্বপ্নের কথাটি বলা হয়নি সবার সুপার ম্যান আহসান হাবীবকে। তিনিও লম্বা সময় নিয়ে সবার কথা শুনতে পারেননি। নিজের ও অন্যের একটাই শান্ত্বনা ছিল, সময় করে শোনা যাবে, সময় করে বলা যাবে। সবার গর্বের আহসান ভাই, আপনি আর কবে সময় নিয়ে সবার কথা শুনবেন— বলতে পারেন? আজ নীরব থাকবেন না, প্লিজ। বলুন না ভাই, কবে শুনতে পারবেন? ভাই আমার নীরব নিথর হয়ে গেছেন। একেবারে শান্ত হয়ে গেছেন। খুব গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন তিনি। এলাকার আলেম, ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইয়েরা, খুব কাছের দূরের আত্মীয়-স্বজনেরা জানাযা শেষে প্রিয় ভাইকে শুইয়ে দিয়েছেন মাটির বিছানায়! বাঁশতলার শীতল মাটির বুকে তিনি গভীর ঘুমে মগ্ন! তাই তিনি আজ কোনো কথার জবাব দিতে পারছেন না! আর পারবেন ওনা কোনোদিন। এটি সুমহান আল্লাহ তা’য়ালার গড়ে দেয়া নিয়ম। এ নিয়ম কেউ ভাঙতে পারে না। এ নিয়ম ভাঙার সাধ্য কারো নেই! সবার প্রিয় আহসান হাবীব ভাইয়েরও সাধ্য নেই মাটির বিছানার ঘুম ছেড় জেগে উঠার, কথা বলার!
এ বিদায় বড্ড কষ্টের! এমন বিদায় মেনে নেয়া যায় না। এমন বিদায় মানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ৩৩তম বিসিএস পাশ করে সহকারী পুলিশ সুপার পদে মাত্র কিছুদিন হলো চাকরীতে জয়েন করা সবার প্রিয় আহসান হাবীব ভাইয়ের এমন অকালে চলে যাওয়া কেউই মানতে পারছেন না। কিভাবে পারবেন? মাত্র ৩২ বছর বয়সের এমন একটা বীর ছেলে চলে যাক, কেউ চান না! গত মে মাসের ২ তারিখ তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেলেন! ৬ জুলাই ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে বারোটায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। পরদিন ১৬ জুলাই শুক্রবার বিকেলে প্রিয় স্বজনদের অশ্রুসিক্ত জানাযা, ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন! শুয়ে গেলেন মাটির ঘরে, মাটির বিছানায়! এত অল্প সময়ে এত তড়িঘড়ি করে কাউকে বিদায় নিতে দেখা যায় না। তিনি বিদায় নিলেন। যিনি আমাদের সবার বুক ভরা গর্ব ছিলেন, সকলের পরম আপনজন ছিলেন। তাই তাঁকে বিদায় দিতে সকলের এত কষ্ট, এত কান্না, এত অশ্রুপাত! তবু মেনে নিতে হবে আমাদের! এটাই সত্যি! এটাই নিয়তি! এটাই মহান আল্লাহ তা’য়ালার লীলাখেলা!
আহসান হাবীব ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা হয়েছে আমার। আহসান হাবীব ভাইয়ের আপন ভাই— ইকবাল ভাই এবং ইউসুফ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। সবার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। জানাযার সময় অশ্রুর জলে ভেসে তাঁরা ভাই হারানোর অমর দুঃখের কথা শুনিয়েছেন আমাদের। ভাইদের, বাবা-মা’র, বোনদের কলিজা ভেঙে চলে গেলেন প্রিয় আহসান হাবীব ভাই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান হাবীবের মেঝো ভাই মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ ভাই বলেছেন, আমাদের সবই তো গেল। আমাদের স্বপ্ন গেল, আমাদের গর্ব গেল! —এই বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের পরিবারের কাউকে সরকার যদি চাকরীর ব্যবস্থা করে দিত! সরকারের প্রতি আকুল আকুতি জানানো অশ্রুসিক্ত পরিবারটির জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। সবশেষে সকলের প্রিয়ভাজন মানুষ, বাংলাদেশ পুলিশের গর্ব, করোনার নির্মম শিকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান হাবীব ভাইয়ের জান্নাতবাস কামনা করছি গভীরভাবে। হে পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ, আপনি কবুল করুন। আহসান হাবীব ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী।।