এসএসসি পরীক্ষার্থী জেসমিন। বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। পারিবারিক অসচ্ছলতায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন তিনি। করোনা মাহামারীতে পারিবারিক অসচ্ছলতা প্রকট হওয়ার পাশাপাশি স্কুল বন্ধ থাকায় বালিকাতেই বধূ সাজতে হয় তাকে। তবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার শর্তে বিয়ের সম্মতি দেন তিনি।
বধূ হলেও শর্তানুসারে স্কুল খোলার দিন থেকে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছেন জেসমিন। স্কুল জীবনেই বিয়ের মত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
এসএসসি পরীক্ষার্থী জেসমিন আক্তার টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও গোবিন্দাসী পূর্ব পাড়া গ্রামের মৃত আবু হানিফ ও গৃহিনী জাকিয়া বেগমের মেয়ে।
গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের শুধু জেসমিন আক্তারই নন। বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে- আমেনা, নূরী খাতুন, স্বর্ণা আক্তার, শাহিনুর, লাকি, নিলুফা, মিতানূর, দিবাসহ ১৭জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে দুইজন ইতোমধ্যে অন্তঃসত্ত্বা।
জেসমিন আক্তার জানান, ৬ বছর আগে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। তারা তিন ভাই-বোন ও মাকে নিয়ে তাদের চার সদস্যের সংসার। এর মধ্যে তারা দুই বোনই বড়। একমাত্র ভাই ছোট ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তিন ভাই-বোন নিয়ে অনেক সমস্যায় ছিলেন তার মা। সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন তার বড় খালা। খালু সরকারি চাকুরির সুবাদে অন্যত্র থাকায় তার বড় খালা তাদের সাথে বসবাস শুরু করেন ও ভোরণপোষণের দায়িত্ব নেন। বড় বোনের বিয়ে হলেও এরই মধ্যে চলে তাদের দুই ভাই-বোনের লেখাপড়া। তারা দুই ভাই বোনই গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
জেসমিন আরও জানান, বৈশ্বিক মহামারী করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। পাত্র ওর পরিবার ভালো পাওয়ায় তার মা সহ অভিভাবকরা ২০২০ সালের আগস্টে তার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। পরিবারের অসচ্ছলতা ও মায়ের অসহায়ত্ব বিবেচনায় জেসমিন বিয়েতে সম্মতি দেন। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার।
শর্ত মেনে ভূঞাপুর উপজেলার ছাব্বিশা গ্রামের মো. নাজিম উদ্দিনে ছেলে শাকিল পারভেজের সাথে তার বিয়ে হয়। স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি লোকজন ভালো এবং শিক্ষিত হওয়ায় তার ইচ্ছানুযায়ী লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সম্মতি দেন।
এ কারণে স্কুল খোলার দিন থেকেই তিনি নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছেন। তার লেখাপড়ার সকল খরচও বহন করছেন স্বামী। তিনি লেখাপড়া করে বড় হতে চান।
জেসমিন আক্তারের স্বামী শাকিল পারভেজ জানান, পরিবারের পছন্দে স্কুলছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। তবে তিনি চান জেসমিন লেখাপড়া অব্যাহত রাখবে। ওর লেখাপড়ার সকল সুযোগ-সুবিধা তিনি দেবেন।
ওই স্কুলের অপর এসএসসি পরীক্ষার্থী নূরী খাতুন জানান, বিয়ের জন্য তিনি প্রস্তুত না থাকলেও বাবার অসুস্থতার কারণে স্কুল জীবনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। তিনিও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার শর্ত দিলে স্বামী মেনে নিয়েছেন। স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে স্কুল খোলার দিন থেকেই তিনি নিয়মিত ক্লাস করছেন। জীবনে নিজে কিছু করার ইচ্ছায় লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন তিনি।
একই ক্লাসের আমেনা বেগম জানান, ইচ্ছে না থাকলেও বাবা-মার পছন্দে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ে হলেও স্বামীর সম্মতি নিয়ে স্কুল খোলার দিন থেকে নিয়মিত ক্লাস করছেন। তিনি লেখাপড়া শেষ করে চাকুরিজীবী হতে চান।
বিদ্যালয়ের শ্রেণি শিক্ষক আব্দুল লতিফ তালুকদার জানান, করোনার বন্ধে দেশের অসংখ্য স্কুলছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। তাদের স্কুলেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এ স্কুলের ১৭জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরও স্কুলে আসছে অনেক ছাত্রী। এটি সত্যিই আশার আলো। তারাও ওইসব ছাত্রীর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাধ্য মত অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন।
গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার মোহাম্মদ আলী জানান, করোনার বন্ধ ও পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তাদের স্কুলের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। তবে বিয়ের পরও তাদের ছাত্রীরা স্কুলে ক্লাস করছে।
তিনি জানান, তার স্কুলের কতজন ছাত্র-ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে এ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত স্কুলের ২৬ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিয়ে হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।