মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে কেন সেদিন কালনি এক্সপ্রেস ট্রেনের অননুমোদিত যাত্রাবিরতি? আর মায়া হরিণটি কেইবা জবাই করেছে? এ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।হরিণ জবাই করে হত্যার দৃষ্টি কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক ও কর্মচারীদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী, রেলওয়ে পুলিশ এবং বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে সে ইঙ্গিতই মিলছে।
ওইদিন কালনি এক্সপ্রেস ট্রেনে থাকা যাত্রীরা বলছেন- হরিণ জবাই করে ট্রেনে তোলার ঘটনায় সরাসরি ট্রেনের চালক ও কর্মচারীরা জড়িত।মৌলভীবাজার বনবিভাগ বলছে- এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, এঘটনায় তদন্ত চলছে। তদন্তে বেরিয়ে আসবে আসল ঘটনা।
এদিকে হরিণ জবাই করে হত্যার ঘটনায় ভাইরাল ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাওয়া সেই দাড়িওয়ালা, কাস্ত হাতে লোকটির পরিচয় পেয়েছে গণমাধ্যমে।মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের একটি মায়া হরিণের জবাই করা দেহ গত বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকাগামী কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে পুলিশ।
হরিণটির গায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং হরিণটি জবাই করা হয়েছে বলে দাবি বনবিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশের। তারা আরও দাবি করেন, এটি মায়া হরিণ এবং একমাত্র এই এলাকার লাউয়াছড়া বনেই এই হরিণ রয়েছে। হরিণটি কীভাবে চলন্ত ট্রেনে আসল তা নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন দেখা দেয়!
লাউয়াছড়া অনুমতিবিহীন ৬ মিনিট দাঁড়িয়েছিলো ট্রেনটি। এ নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক লাউয়াছড়া বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে হরিণটি জবাই করেন এবং সেই সময় কোনো অনুমতি ছাড়া তিনি ৬ মিনিট হরিণ জবাই করার জন্য ট্রেনটি লাউয়াছড়া বনের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখেন। ওই ট্রেনের একাধিক যাত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সন্তোষ দাস। তিনি কুলাউড়া থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্য ট্রেনে উঠেন।
তিনি বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় আসার কিছুক্ষণ পর আমি ওয়াশরুমে যাই, হঠাৎ করে দেখি ট্রেন থেমে গেছে। আমি সাথে সাথে বের হই, তারপরে শুনি যে একটা হরিণের জন্য ট্রেন থেমেছে। কেউ বলছে শিকারীরা হরিণকে ফায়ার করছে, হরিণ দৌড় দিয়ে গাড়ির সামনে পড়ছে, আবার কেউ বলছিল বন বিভাগের লোকজন সাথে ছিল। পরে দেখলাম হরিণ আহত হয়েছে, এর জন্য জবাই করছে। জবাই অবস্থায় নিয়ে আসতে দেখছি। অনেকে ভিডিও করছে। এরপর ট্রেন ছেড়ে দেয়।’
এই ট্রেনের আরেক যাত্রী কমলগঞ্জের সুমন আহমদ জানান, ট্রেনটি লাউয়াছড়া বনের ভেতর আসতেই থেমে যায়। ছয় থেকে সাত মিনিট পর একটি হরিণ নিয়ে এসে আবার ট্রেন ছাড়ে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেদিন ট্রেনটি দেরি করে স্টেশনে পৌঁছায়। ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার তার রেকর্ড বুক থেকে জানান, ভানুগাছ থেকে ৮.২৮ মিনিটে ট্রেনটি ছেড়ে যায় এবং ৮.৫৪ মিনিটে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছায়। সাধারণ সময়ে ২০ মিনিট লাগলেও ঐদিন লাগে ২৬ মিনিট।
ভাইরাল ব্যক্তিদের পরিচয় পাওয়া গেছে!
হরিণ জবাই করে হত্যার ঘটনায় ভাইরাল ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায় ঢাকাগামী চলন্ত কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বনের ভেতরে থামানো রয়েছে। এ সময় একজন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি হাতে কাস্ত নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটছেন। তার পেছনে আরও ৪ থেকে ৫ জন লোক মিলে জবাইকৃত হরিণ ধরে ইঞ্জিন রুমে তুলছেন। তাৎক্ষণিক হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি আবারও ছেড়ে যায়।
ভাইরাল হওয়া ছবির ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, ধারালো অস্ত্র কাস্ত হাতে মুখে দাড়িওয়ালা সাদা শার্ট পড়া লোকটি রেলওয়ের কর্মচারী এনামুল হক সোহেল। তিনি রেলওয়ে লাইন মেকানিকের কাজ করেন। জবাইকৃত হরিণকে ঝুলিয়ে নেওয়া অপর ব্যক্তি হলেন ট্রেনের সহকারী চালক। তবে তার নাম জানা যায়নি। তাদের সাথে থাকা অন্যরাও ট্রেনের কর্মচারী।
সন্দেহের দৃষ্টি ট্রেন চালক ও কর্মচারীদের দিকে বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ট্রেন না থামিয়ে কোনো ভাবেই হরিণ ট্রেনে চলে আসার কথা না। এই হরিণের গায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ট্রেনের গায়ে লেগে হরিণটি আহত হয় পরে জবাই করে ট্রেনে তোলা হয়।
বনবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের শতভাগ ধারণা যে চালক ট্রেন থামিয়েছেন এবং জবাই করে তা ট্রেনে তোলা হয়। কারণ ট্রেন না থামালে তা কোনোভাবেই ট্রেনে তোলা সম্ভব নয়। এই মায়া হরিণ লাউয়াছড়া বনেই সাধারণত দেখা যায় এবং অতীতেও ট্রেনের ধাক্কায় হরিণ আহত বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ময়নাতদন্তে জানা যায়, হরিণটি জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। যদিও এর গায়ে আরও আঘাত ছিল।শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কর্ণ চন্দ্র মল্লিক বলেন, ‘আমরা পোস্টমর্টেম করে বুঝতে পেরেছি প্রাণিটিকে ধারালো কোনো জিনিস দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।’
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র জানান, ঢাকাগামী কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানা পুলিশ। পরে তারা আমাদের জানায়। আমার ধারণা চলন্ত রেলের আঘাতে হরিণটি আহত হয় এবং পরে জবাই করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা পোস্টমোর্টেম করে জানতে পেরেছি জবাই করার কারণেই তার মৃত্যু হয়। গায়ে আঘাতের দাগ থাকলেও তার কারণে মৃত্যু হয়নি। জবাই না করলে এই আঘাতে সুস্থ হয়ে যেত।’লাউয়াছড়া ট্রেন থামিয়ে হরিণ জবাই করার ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রাণপ্রকৃতি সংরক্ষবরা। সচেতন মহল থেকে শুরু করে, বন্য প্রাণী উদ্ধার সংঘটনের অনেকে বলেন,
এটা অতিব ভয়াবহ পরিস্থিতি। ভয়ংকর! লাউয়াছড়ায় দিনের আলোতে প্রকাশ্য দিবালোকে ট্রেন থামিয়ে হরিণ জবাই করে ইঞ্জিন রুমে তুলে নিয়ে আসার মতো ঘটনা সাধারণ কোন ঘটনা নয়! এটি প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য ভয়ংকর একটা একটা বিপদসংকেত ৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা ছবি এবং ভিডিও দেখে বোঝা যায় তারা অত্যন্ত সাবলীল এবং দক্ষ ভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজটা করেছে৷
অতীতেও যে তারা এরকম ঘটনা বা এর চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটানো হয়নি সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়না৷ দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা তাদেরকে এতটা বেপরোয়া করে তুলেছে!
তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, ‘আমার ধারণা ট্রেনের আঘাতে আহত হয়। পরে তা ট্রেনে তোলা হয়। কীভবে তোলা হয়েছে তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।’কালনী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের সেই চালকের সাথে কথা বলার জন্য একাধিকবার শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করলেও তিনি চালকের মোবাইল নাম্বার দিতে পারেননি। বিষয়টি নানাভাবে তিনি তালবাহানা করে এড়িয়ে যান।
তবে এ বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে বনবিভাগ। বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত করছে রেলওয়ে পুলিশ।
রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী জানান, এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন সামনে আসছে, সঠিক কিছু বলা যাচ্ছে না তদন্ত ছাড়া। তবে হরিণটি লাউয়াছড়ার এবং সেখান থেকেই ট্রেনে উঠানো হয়েছে তা নিশ্চিত।