পুরাতন ব্রম্ভ্রপুত্র পললগঠিত সমতল ভুমি ও হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবন জীবিকা ও সম্পদ বিনিময় ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে ঠিকিয়ে রেখেছিল নেত্রকোনা অঞ্চলের জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫৮ টি নদী, নালা,খাল, কংস, মগড়া, সুমেশ্বরী, উব্দাখালী, ধনু, ঘোড়াউৎড়া, বিষনাই, ধলাই সাইডুলী, পাটেশ্বরী, গণেশ্বরীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নদী, সহস্রাধিক খালবিল, ৩৫ হাজার ৯৩২ পুকুর ও ছোটবড় ৮৩টি হাওর ১৫৬ টি বিল রয়েছে নেত্রকোনার ভূমিতে। নেত্রকোনার প্রাকৃতিক পরিবেশ, এই হাওর,বিল, নদী,খাল, জল জলাশয়ের উপর ,জলের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেছে । এ অঞ্চলের মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল।
৫৮ টি নদীর প্রবাহ পানি,কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধি,নদীর, হাওরের পানির সেচের মাধ্যমে কৃষকের কৃষি চলতো, ঘরে তোলতো মাঠের ফসল। প্রবাহমান এসব নদীর বিলুপ্ত,ভরাট,পানি শূন্যতা কৃষিকে করেছে বিপর্যস্ত। মগড়া,সাইডুলি, পাটকুড়া,বিষনাই নদীতে কৃষকেরা শতশত মেশিন বসিয়ে সেচের পানি সংগ্রহ করতো।কিন্তু এখন আর নদীতে পানি নেই। বোরো আবাদেও জন্য মানুষের হন্যে হয়ে ভূগর্ভেও পানি উত্তোলনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সাথে সাথে বাড়ছে উৎপাদন খরচওফলে পানিতে আয়রণের পরিমান বাড়ছে,বাড়ছে পানি দূষণ ও রোগ, বিপন্ন হচেছ পরিবেশ প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য। মানুষের জীবন পেশা,সংস্কৃতি,খাদ্য,পুষ্টি,মাছ ও যোগাযোগের উৎস এই জলাভূমি।
এ জেলায় ব্যক্তি মালিকানার কিছু পুকুর ছাড়া প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে সকল জলাভূমি। বিল, জলজলাশয়, মানুষের জীবন, পেশা, শিক্ষা, সংস্কৃতি,আনন্দ বিনোদন, কৃষির ফলনে জলাভুমির অবদান বিছিন্ন করা যায়না। দিন দিন কমতে থাকে নদী,হাওর,বিল, জলাশয়,খাল,বিল, প্রাকৃতিক এসব সম্পদের উপর থেকে মানুষের বিছিন্নতা বাড়তে থাকে। ফলে মানুষের জীবন ঝুকি পূর্ণ হয়ে পড়ে। মানুষ বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কমতে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদে অভিগমতা, পারস্প রিক নির্ভরশীলতা ও বিনিময়, বাড়তে থাকে সম্পর্কহীনতা।
নদী ,খালবিল,হাওর,জলাভুমি বিলুুপ্তির ফলে কমছে প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য,মানুষ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে চাষকৃত মাছের উপর, প্রাকৃতিক মাছের উপর নির্ভরশীল জেলে পরিবার গুলো দিন দিন ঝুকির মাঝে পড়ে যাচ্ছে। পেশা হারিয়ে বেমানান হয়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়ে।। জল,জাল,নদী,হাওর, বিল কিছুই আর জেলেদের নিয়ন্ত্রনে নেই । দিনদিন কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ.দখল হয়ে যাচ্ছে জলমহাল,শুকিয়ে যাচ্ছেনদী, নালা, খালবিল, মাছের অভয়াশ্রম, প্রজনন কেন্দ্র, বিলূপ্ত বিপন্নমাছের প্রজাতি,হারিয়ে যাচ্ছে পেশা, জীবনে নেমে আসছে দারিদ্রতা।
আজকাল আর নেত্রকোনার পাহাড়ি নদী ও খরস্র্রোতা হাওরে রক্তিম রঙের পাখনা ও লেজ দোলানো সোনালি মহাশোল দেখা যায় না। শুধু মহাশোল নয় দেশীয় প্রজাতির মাছ রুই, কাতলা, বানহারি, বাগাইর,গুতুম কাজলি, কালা বাউশ, কৈ চিংড়ি, মাগুর, শিং, টেংরা, পাবদা, মলা, ঢেলা, চাপিলা, পাঙ্গাশ, শোল, চিতল, আইড়, মৃগেল,বাইম মাছসহ, কাছিম, কাঁকড়া, সাপসহ নানা প্রজাতির জলপ্রাণীর ভান্ডার ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে।
নদী ও সংস্কৃতি একসাথে গাথা। নদীকে কেন্দ্র করে গান,কবিতা, গল্প, অনুষ্ঠান, নৌকা বাইচ, নৌকা ভ্রমন, কতকিছুই না রচিত হতো, আয়োজন হতো। নদী হারিয়ে যাওয়া মানে সংস্কৃতি হারিয়ে যায়, গান হারিয়ে যায়,বিনোদন হারিয়ে যায় ,ভাষা হারিয়ে যায়।
আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের নেত্রকোনার প্রকৃতি ,পরিবেশ,প্রাণ,প্রাণসম্পদ,নদীনালা,খালবিল হাওর রক্ষা করা প্রযোজন। প্রকৃতি থেকেই মানুষ শিখেছে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক অতি প্রাচীন ও দুর্গম। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্পর্শে প্রকৃতি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ সেজেছে নব নব রুপে। টিকে থাকার সংগ্রাম উভয়কেই করেছে বৈচিত্র্যময়।
মানুষের টিকে থাকার জন্যেই প্রাণী উদ্ভিদ জল বায়ু মাটি। তাই টিকে থাকার জন্যেই মানুষের উচিত তাদের প্রকৃতিকে সচল রাখা। মূলত প্রত্যেকটি সমাজব্যবস্থায় প্রতিবেশ, সমাজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সামাজিক বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সামাজিক এ বৈচিত্র্যে জন্ম হয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকে। ভূ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্ম হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য থেকে। তাই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নেত্রকোনার মানুষকে এগিয়ে আসতে।
অভিন্ন নদ অববাহিকায় গড়ে ওঠা নেত্রকোণা অঞ্চলে এককালের প্রমত্ত মগড়া আজ কেবলি স্মৃতি। দিনে দিনে নেত্রকোণার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে তুষাই, বরুণী, চিল্লাই, নাগঢড়ার মতো নদীপ্রবাহ। পিয়াং, মহাদেও, মরা সুরমা, মাদল মরানদী, গণেশ্বরী, মগড়া, কালা মগড়া, বিষনাই, সাইডুলি, ভোগাই কংশ, সোমেশ্বরী, ধনু, উবদাখালী নদীগুলোও মৃতপ্রায়। বাগড়া হাওর, গুরমার হাওর, ভল্লার খাল, ধুনয়া বিল, বনুয়া বিল, বুড়াদিয়া বিল, চাড়িয়া জলমহাল, সুমাইয়াখালী, নাজিরখালী, রায়খালী, বিষখালী, বিল হেলুচিয়া, গাইনা বিল, পেতনি বিল, ঢালার খাল, ধলাই খাল, তেরজান, জলচন্দ্রপুর, রাজাখালী, কাবুলীয়া, নতিবিল, বেকুয়া বিল, ভাওল বিল, আঙ্গুরা বিল,
পাতিয়াখালী, পাগলার বিলসহ নেত্রকোণার হাওর-বিল-জলাভূমিসমূহ আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। এমনকি পুকুর, দীঘি, কুয়া ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের পাহাড়ি ছড়াগুলোও আজ আর আগের মতো নেই। উন্মুক্ত জলাশয় এবং প্রাকৃতিক প্রবাহ ধ্বংস হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মানুষের নানান অপরিকল্পিত কর্মকান্ড। নদী ভরাট, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, উজানের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি বালির ঢল, বাণিজ্যিক মৎস্যচাষ, ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার দিনে দিনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই নেত্রকোণা অঞ্চলেও প্রাকৃতিক পানির উৎস গুলো নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে জলজ প্রাণবৈচিত্র্য।
নদী ও হাওর পাড়ে গড়ে ওঠে জেলে পাড়াগুলো। সঙ্গতকারণেই জেলেদের জীবনজীবিকা,পেশার জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলো জলাভূমির উপর । জলাভূমিতে মাছ ধরতো, কাডা দিতো, খরাজাল, বেরজাল, ঝাকিজাল, বাইড়,চুঙ্গা, বড়শী,হরগা, দিয়ে সারাবছর মাছ ধরতো। বংশ পরমপরায় তাদের জীবন চলতো। জেলেরা পুুটি মাছের শুটকি দিয়ে অভাবের সময় নিদান পাড়ি দিতো। জলাভূমি দখল,বিলুপ্তি,দুষণের ফলে,জেলা পেশা হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাচেছ।
নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস,ঐহিত্য জলাশয় মিশ্রিত,নদী আশ্রিত,নদী প্রশ্রিত। পল্লীগীতি,জারি,সারি,ভাটিয়ালি,প্রভূতিতে জলাভূীমর অবগাহন,নদীর জলে পরিশুদ্ধি,নদীর জলে চাষাবাদ,ভূমি উর্বরা,পলিপতন,ভূমির পুষ্টি বৃদ্ধি,যোগাযোগ যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে। জলাভ’মি দিয়েছে,নদী দিয়েছে, আমরা নিয়েছি, শুধু নিয়েছি, এভাবে জলাভূমি নিজেকে উজার করেছে।
নি:স্ব হয়েছে। বিলিন হয়েছে। আমরা থেমে থাকিনি, আমাদের অভাব পূরণ হয়নি। আামাদের লোভ,লাভের সীমাহীন পাওয়ার আশায় জলাভূমির অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছি। আমারা তবুও থামিনি। আসুন জলাভূমি বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই, আমরা বাঁচি, নেত্রকোনা বাঁচাই।