কুমিল্লা দেবীদ্বারে শিশু ফাহিমা(৫) হত্যাকান্ডে পাষণ্ড বাবা আমির হোসেন ও প্রেমিকা লাইলিসহ জড়িত ৫ জনকে কে আটক করেছে র্যাব ১১। গত সোমবার সকালে নিখোঁজের ৭দিনপরে উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর দেবীদ্বার-চান্দিনা সড়কের পাশে একটি ব্রীজের গোড়া থেকে বাজারের ব্যাগ ভর্তি ক্ষতবিক্ষত গলিত শিশু কণ্যা ফাহিমার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গত মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) চাপানগর গ্রামের ভিক্টিমের পিতা আমির হোসেন(২৫) (পিতা-জহিরুল ইসলাম), মোঃ আবুল কালাম(৩৫) ও তার স্ত্রী লাইলী আক্তার(৩০) এবং মৃত: লিলু মিয়ার পুত্র মোঃ রবিউল আউয়াল(১৯), সিএনজি চালক মোঃ সোহেল রানা(২৭)সহ আরো ৫জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব’র কার্যালয়ে নিয়ে যায়।
র্যাব’র কার্যালয়ে ১৩জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমির হোসেন, লাইলী আক্তার, রবিউল আউয়াল, সোহেল রানা ও রেজাউল হোসেন ইমনসহ ৫জনকে আটক রেখে বাকী ৮জনকে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কোন সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
বুধবার সকালে র্যাব’র মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ ব্রিফিং-এ জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ঘটনার বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা অনুসন্ধানের পর শিশু ফাহিমা হত্যায় যোগসাজশের তথ্য পাওয়ার পরই বাবা আমির হোসেনসহ পাঁচ আসামিকে মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) দিবাগত রাতে গ্রেফতার করে র্যাব-১১ এর একটি দল।
ফাহিমা দেবীদ্বার পৌর এলাকার চাপানগর (চম্পকনগর) গ্রমের ট্রাক্টর চালক আমির হোসেন ও গৃহিনী হোছনা বেগম’র একমাত্র কণ্যা। হোছনা বেগম বর্তমানে ৩ মাসের অন্তস্বত্বা। সে ৭ নভেম্বর বিকেলে বাড়ির আঙ্গীনায় খেলতে যেয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় নিজ গ্রামে, স্বজনদের বাড়ি, হাসপাতাল সহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজা খুজি করে এবং মাইকিং করে, না পেয়ে গত ১১ নভেম্বর দেবীদ্বার থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন।
অপরদিকে কবিরাজ মাঈনুদ্দিনের ভক্ত চাপানগর গ্রামের একাধিক মুরিদান ফাহিমাকে উদ্ধারে কবিরাজ মাঈনুদ্দিন শাহ’র স্মরনাপন্ন হন। মাঈনউদ্দিন শাহের অর্থের বিনিময়ে ফাহিমা জীবিত আছে এবং জ্বীন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে বলে সময় কালক্ষেপণ করতে থাকে। ঘটনার পর থেকে জ্বীন চালান দেয়া মাঈনউদ্দিন শাহ পলাতক রয়েছে বলে জানা যায়।
১৪ নভেম্বর ফাহিমার পিতা আমির হোসেন বাদী হয়ে দেবীদ্বার থানায় অজ্ঞাত আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়ের এবং লাশ উদ্ধারের পর থেকেই এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে কুমিল্লা এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-১১ সিপিসি-২ এর উপ-পরিচালক মেজর সাকিব হোসেন, পিবিআই’র উপ-পরিদর্শক (এসআই) মতিউর রহমান, দেবীদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক (এস,আই) সোহরাব হোসেন সহ একাধিক টিম দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা এসময় স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন মোবাইল নম্বর ও সিসি ক্যামের ফুটেজ, চাপানগর গ্রামের মোঃ রেজাউল হোসেন ইমন’র একটি ডেইরী ফার্মের খাদ্য সরবরাহে ব্যাগ যার সাথে ফাহিমার মরদেহ উদ্ধার হওয়া ব্যাগের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া একাধিক ব্যাগ আলামত হিসেবে উদ্ধার করেন।
নিহত শিশুর ময়নাতদন্ত শেষে জানাযার প্রাক্কালে গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে র্যাব- ১১’র একটি গোয়েন্দা দল চাপানগর গ্রামের মৃত: সামসুল হক’র পুত্র স্থানীয় মসজিদের মোয়াজ্জিম মোঃ হাবিবুর রহমান(৫৫), হাবিবুর রহমানের ৪ পুত্র কবির হোসেন(৩২), ফখরুল ইসলাম(৩০), মোঃ রাসেল(২৬) ও মোঃ রেজাউল হোসেন ইমন(২২)সহ ৫জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুমিল্লা র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যান। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন রাতেই একই গ্রামের আব্দুল খালেক(৬৮), তার ছেলে সাইফুল(২৫) ও আব্দুর রাজ্জাক(২০)কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুমিল্লা র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
র্যাব’র ওই কর্মকর্তা আরো জানান, গত ৫নভেম্বর ভিক্টিমের বাবা আমির হোসেনকে পার্শ্ববর্তী একজন মহিলা লাইলী আক্তার’র সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে তার মেয়ে ফাহিমা আক্তার। ফাহিমা তার মা’কে বিষয়টি জানিয়ে দেবে বলেও জানায়। তখন লাইলী আক্তারের প্ররোচনায় আমির হোসেনের দুই চাচাতো ভাই রেজাউল ইমন, রবিউল আউয়াল ও তাদের বন্ধু সোহেলসহ রেজাউলের ফার্নিচারের দোকানে বসে একটি পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনানুযায়ী আমির হোসেন তার মেয়েকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। বিনিময়ে রেজাউল, রবিউল, সুমন তার মেয়েকে হত্যার জন্য এক লক্ষ টাকা দেয়ার অর্থ দাবী করলে আমির হোসেন শ্বশুর বাড়ি থেকে আনা যৌতুকের এক লক্ষ টাকা দেয়ার শর্তে রাজী হয়।
পরবর্তীতে লাইলী আক্তার’র সাথে আলোচনা স্বাপেক্ষে ৭ নভেম্বর রেজাউল, রবিউল, সুমন, লাইলী আক্তার ও আমির হোসেন ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ফাহিমাকে সোহেলের সিএনজিতে করে ঘুরতে যায়। এক পর্যায়ে সন্ধ্যা হয়ে আসলে খাবারের কথা বলে রাস্তার পাশে একটি নির্জন স্থানে তাকে নিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে রেজাউল ইমন তার গরুর খামার থেকে ২৫ কেজি ওজনের ২টি প্লাষ্টিকের গরুর খাবারের ব্যাগ নিয়ে আসে। রবিউল একটি ছুরি, ও আমির হোসেন তার ঘর থেকে আরো একটি ছুরি নিয়ে আসে। পরবর্তীতে তারা ৪ জন মিলে ফাহিমাকে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। প্রথমে আমির হোসেন তার মেয়েকে মাথায় চেপে ধরে তার উপর ছুড়ি চালায়, পরবর্তীতে একে একে রবিউল এবং সোহেল ছুরি দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। তখন লাইলী আক্তার পাশে দাড়িয়েছিল। সব শেষে ভিক্টিমের পিতা আমির হোসেন তার গলা চেঁপে ধরে। শ্বাস রোধে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে তারা ৪জন মিলে ফাহিমার মরদেহ প্লাষ্টিকের ব্যাগে ঢুকায়।
আশপাশের মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাগটি সিএনজিতে তুলে নেয় এবং রাস্তায় ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। তবে রাস্তায় সুবিধাজনক কোন জায়গা না পাওয়ায় রেজউল ইসলাম ইমন তার গরুর খামারের পাশের একটি ড্রামে লুকিয়ে রাখে।
এদিকে ভিক্টিমের মা’ ও পরিবারের লোকজন ফাহিমাকে খুঁজে না পেয়ে আমির হোসেনকে ফোনে বিষয়টি জানান। আমির হোসেন এসে ওই হত্যাকান্ডে ব্যবহারের সিএনজি করে ওইরাত থেকে পরদিন পর্যন্ত মাইকিং করেন। হত্যাকারীরা তাদের ফেইজ বুকে ফাহিমা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ফলাউ করে প্রচার করতে থাকে। অবশেষে কবিরাজ এব জ্বীন চালকের স্মরনাপন্ন হয়েছেন, তারা দু’দিন চেষ্টা করেও কোন খোঁজ দিতে পারেননি।
আমির হোসেন মেয়েকে খুঁজতে বিভিন্ন স্থানে দৌর ঝাপ করেন। এ সময় ব্রাক্ষণবাড়িয়া একটি মেয়ে পাওয়া যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমির হোসেন। তার শ্বশুর শাশুরীকে নিয়ে মেয়ের সন্ধানে সেখানেও যান। ৯ নভেম্বর রাতে লাইলী আক্তার ছাড়া বাকী ৪জন উপজেলার কাচিসাইর গ্রামের নির্জন ওই স্থানের কালভার্টের নিচে ভিক্টিমের লাশ ভর্তি ব্যাগটি ফেলে আসেন।
পরবর্তীতে লাশ উদ্ধার ও জানাযা শেষে ১৬ নভেম্বর আত্মীয় স্বজন ও এতিমদের নিয়ে ফাহিমার কুলখানী সম্পন্ন করেন ঘাতক পিতা আমির হোসেন। লাইলী আক্তারের সাথে আমিরের শর্ত ছিল, প্রয়োজনে স্ত্রী হোছনাকে হত্যা করে হলেও লাইলীকে বিয়ে করবে।