অরক্ষিত অবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে পড়েছিল পাকিস্তানি খানসেনাদের পুতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে শহীদ হওয়া ভারতীয় মিত্র বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ পাঁচ সেনা সদস্যের সম্মানার্থে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি। স্তম্ভটিকে ঘিরে চারপাশে দেয়া হয়েছিল ৩ ফিটের প্রাচীর। আর সেই প্রাচীরে ছিল লোহার অ্যাঙ্গেলের গ্রীল।
অবহেলা অযত্নে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের পেছনে ছোট যমুনার তীরে ৭১’এ নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ে থাকতে থাকতে চুরি গেলো সেই প্রাচীরে থাকে লোহার অ্যাঙ্গেলের গ্রীল।
সরেজমিনে দেখা যায়, কিছুদিন আগে রাতের আঁধারে কে বা কারা স্মৃতিস্তম্ভের প্রাচীর ও ইটের তৈরি পিলার (খুঁটি) ভেঙ্গে লোহার অ্যাঙ্গেলের তৈরি গ্রীল চুরি করে। এতে বর্তমানে ধ্বংস্তুপ রূপে পড়ে আছে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ওই স্মৃতিস্তম্ভটি।
জানা যায়, প্রফেসর মো. নজমুল হক ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকাকালিন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কার করে কিছু অংশ ইটের দেয়াল ও পিলারসহ লোহার অ্যাঙ্গেলের গ্রীল দিয়ে সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা সামাজিক ও মানবিক সংগঠন আমরা করব জয় এর সদস্যরা সেটি সংস্কার পূর্বক সেখানে সচেতনতামূলক ও সে স্মৃতিস্তম্ভের তৎপর্য তুলে ধরে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর ওই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে।
আমরা করব জয় সংগঠনের সভাপতি সাংবাদিক প্লাবন শুভ বলেন, স্মৃতিস্তম্ভের ঘেরার গ্রীল চুরি গেছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও লজ্জার বিষয়। গত বছর স্মৃতিস্তম্ভসহ আশপাশের এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ১০ ডিসেম্বর ৭১ এর শহীদ ভারতীয় মিত্র বাহিনীর স্মৃতিস্তম্ভে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এবং আমরা করব জয় সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়েছে। আমরা এমন জাতি, যারা দেশের জন্য আত্মত্যাগ করে গেলো তাদের স্মৃতিস্তম্ভের লোহাও চুরি করে খেতে হয়। এটি জাতির জন্য লজ্জার বিষয়।
ফুলবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. এছার উদ্দিন বলেন, এটি একটি নিন্দনীয় ঘটনা। শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভের ঘেরার গ্রীল চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. আহসান হাবীব ডিজু বলেন, কে বা কারা সোমবার (২৯ এপ্রিল) রাতে স্মৃতিস্তম্ভের লোহার গ্রীলটি চুরি করে নিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে এবং স্মৃতিস্তম্ভটি পুনরায় সংস্কার পূর্বক প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, বিষয়টি জানা নেই। এ বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মো. আল কামাহ্ তমাল বলেন, এমন কোন তথ্য জানা নেই। তবে অধ্যক্ষের সাথে কথা বলে থানায় জিডি করানোর ব্যবস্থা করা হবে।
উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর ফুলবাড়ী হানাদার খানসেনা মুক্ত হওয়ার পর ফুলবাড়ীকে নিয়ন্ত্রণ নেয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সেনা সদস্যরা। ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন অশোক কুমার ক্ষেরের নেতৃত্বে পাঁচজন ভারতীয় সেনা সদস্য জীপ গাড়িতে টহল দেওয়ার সময় পাকিস্তানী খানসেনাদের পুতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে জীপ গাড়িটি উড়ে যায়। এতে মিত্র বাহিনী ওই ক্যাপ্টেনসহ পাঁচ সেনা সদস্য ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরে তাদেরকে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের পূর্ব প্রান্তে ছোট যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। ওই সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর শহীদদের সম্মানার্থে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের পূর্বপ্রান্তে ছোট যমুনা নদীর পশ্চিম পার্শ্বে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিন পর হলেও কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. নজমুল হকের প্রচেষ্ঠায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কার পূর্বক ইটের পিলার দিয়ে বেড়াঘেরাসহ লোহার অ্যাঙ্গেলের গ্রীল দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলিও নিবেদন করা হয় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষের পক্ষ থেকে।